Latest courses

সাহিত্যের স্বরূপ ও শ্রেণীবিভাগ

 

সাহিত্যের স্বরূপ ও শ্রেণীবিভাগ

মানুষের জীবনযাপনের রূপ ও প্রকৃতি বিচিত্র। সভ্যতার আদিকাল থেকে এই বিচিত্র-রূপী জীবন উপভোগের জন্য মানুষ কেবল বন্তগত উপাদানের ওপরই নির্ভর করেনি। সৃষ্টি করেছে অনুভূতি প্রকাশের বিচিত্র আঙ্গিক। আদি মানব পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদানের জন্য প্রথম যে ধ্বনিটি উচ্চারণ করেছিলো, তাই সভ্যতার আদি শিল্প। ধ্বনি > শব্দ > ভাষা এই বিবর্তন পরম্পরার মধ্য দিয়ে সঙ্গীত সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পরূপের জন্ম হয়েছে। সভ্যতার একেকটি পর্যায়ে একেকটি সাহিত্য রূপের (Literary Form) জন্ম হয়েছে। মানুষের জীবনযাপনের প্রকৃতি, ভাব ও ভাবনা, চিন্তা ও প্রকাশক্ষমতার বৈশিষ্ট্যই বিভিন্ন যুগে সাহিত্যের রূপ ও শাখাগুলোর জন্ম দিয়েছে। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রধান কয়েকটি আঙ্গিক । বিষয়ভাবনা ও বিন্যাসের দিক থেকে প্রতিটি সাহিত্যরূপই স্বতন্ত্র ।

সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে একটি নির্বস্তক ধারণা । বস্তুর স্বভাব ও প্রকৃতি দিয়ে এর বিচার সম্ভব নয়। আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা, সংবেদনশীলতা প্রভৃতি যে সকল ধারণা আমরা সাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি এর কোনোটাই বন্তস্বভাবকে প্রকাশ করে না। কিন্তু মানুষের বাস্তব জীবনই সাহিত্যসৃষ্টির উত্স। সাহিত্যের স্বরূপ ও শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে এ-কথাগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। ব্যক্তিমানুষ যেমন আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়না, তেমনি মানুষের সৃষ্ট সাহিত্য শুন্য থেকে আবির্ভূত হয়না।

সাহিত্য-শিল্প যে জীবন থেকে উদ্ভূত - এই ধারণা প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত। গ্রীক দার্শনিক ও তাত্তিক পেটো (খ্রি. পূ. ৩য়-পর্থ শতক) তাঁর (Republic) গ্রন্থে শিল্প-সাহিত্যসৃষ্টির বেশ ক'টি সূত্র নির্দেশ করেছেন: 

১. শিল্পসৃষ্টি হলো অনুকরণ । মানুষের অভিজ্ঞতার জগৎই শিল্পসাহিত্যের অবলম্বন । তিনি মনে করতেন কবির সৃষ্টি অনুকরণের অনুকরণ এবং তা মিথ্যা।

২. শিল্পের সঙ্গে নীতির সম্পর্ক সুগভীর । শিল্পের শ্রেষ্ঠত্ব নৈতিক গুণাবলীর উপর নির্ভরশীল ।

৩. সাহিত্যশিল্প ভাবের বিষয়, জ্ঞানের বিষয় নয়।

৪. দর্শনের সত্য শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। এই ধারণার ফলে সাহিত্যের সত্য ও দর্শনের সত্যের মধ্যে তিনি কোনো পার্থক্য নির্দেশ করতে পারেন নি।

৫. কাব্যে রূপের চেয়ে ভাবই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।

এই সূত্রগুলো থেকে বোঝা যায় পেটো অনুকরণ বলতে অবিকল প্রতিরপ বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু প্লেটোর ছাত্র ত্যারিস্টটল (প্রি. পু. ৪র্থ শতক) অনুকরণের বিশেষ লক্ষণ হিসেবে অনুকরণকে প্রাধান্য দিলেন । তাঁর মতে শিল্প এবং সাহিত্যের পার্থক্যের মাধ্যম হলো ভাষা । তিনি অনুকরণ শব্দটিকে গ্রহণ করেছিলেন ব্যাপক অর্থে । তাঁর মতে সাহিত্য জীবনের অনুকরণ ___ যে জীবনে ঘটনা, অনুভূতি, চিন্তা, কর্ম, বাস্তব অপেক্ষা সত্য হয়ে ধরা দেয়। এই অনুকরণ-তন্তুটি দীর্ঘকাল সাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রে একটি প্রধান মানদন্ড হিসেবে গৃহীত হয়েছে। সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ ছিলো ভাষাহীন, নিঃশব্দ । তখন মানুষের ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিলো বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি। প্রয়োজন ছিলো একান্তভাবেই বন্তগত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে মানুষের চিন্তা, কর্ম ও অনুভূতির বহুমুখী বিস্তার ঘটে। মানুষের সম্পর্ক যেমন স্থুল, বস্তসর্বদ্ব থাকেনা, তেমনি তার জীবনযাপন ও জীবন উপভোগের ক্ষেত্রেও সংবেদনশীলতা ও সুক্্তার প্রকাশ ঘটতে থাকে । আদি মানব তার ভাব প্রথম প্রকাশ করে চিত্রের মাধ্যমে __ প্রাচীন গুহাগাত্রে এখনও তার নিদর্শন বিদ্যমান । ভাষা আবিষ্কার হবার পর মানুষ ক্রমান্বয়ে তার বিচিত্র ভাবকে আঙ্গিকের আশ্রয়ে প্রকাশ করতে থাকে ।

এভাবেই মানুষের আদি শব্দশিল্প কবিতার সৃষ্টি। নাটকের আবিভর্বি হয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন উপযোগী শিল্পমাধ্যম তৈরির প্রয়োজনবোধ থেকে । সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় এভাবেই মানুষ ক্রমান্বয়ে তার জীবনযাপন, জীবন উপভোগ ও তার সূষ্্মতর প্রকাশের প্রয়োজনে বিভিন্ন সাহিত্য আঙ্গিকের সৃষ্টি করেছে। এ-ভাবেই ক্রমান্বয়ে মানুষ তার প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছে উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ। 

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাত্বক  পাঠনক্রমে সাহিত্যের উলিখিত শাখাগুলো অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। এই শাখা বা শ্রেণীর স্বরূপ অনুধাবনের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীহ কিছু প্রাথমিক মৌলিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ-প্রসঙ্গে প্রথমেই আসবে শ্রেণীবিভাজনের প্রশ্ন। আবার শ্রেণী বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিভিন্ন রূপে বিভক্ত সাহিত্যরূপ বা ফর্ম (যেমন, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ) বুঝতে হলে তার ভাব বা বিষয়বন্ত (Content) এবং গঠনকৌশল (Structure) সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এ-প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখেই আমরা “সাহিত্যের স্বরূপ ও শ্রেণীবিভাগ" পর্ব পাঠ্যসূচির শুরুতে অন্তর্ভূক্ত করেছি এবং নিম্নোক্ত ক্রমানুসারে সেগুলো উপদ্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি: উদ্দেশ্য, উপরি-উক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রাথমিক প্রয়োজনীয় ধারণা লাভ এবং সাহিত্যের স্বরূপ, রস ও বিভিন্ন শাখাগুলোকে বিচার করার দক্ষতা অর্জন । একজন স্বাবলম্বী শিক্ষার্থী হয়ে উঠতে সকলেরই যা কাম্য ।

Post a Comment

0 Comments