Latest courses

জীবন ও বৃক্ষ - মোতাহের হোসেন চৌধুরী

 

লেখক-পরিচিতি - মোতাহের হোসেন চৌধুরীর জন্ম ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালী জেলার কার্চনপুরে | তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন 'বুদ্ধির যুক্তি আন্দোলন" নামে পরিচিত বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগতির এক যুগান্তকারী আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি হিসেবে । সাহিত্যের অঙ্গনে ও বাস্তব জীবনে উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সৌন্দর্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি-চেতনা ও মানবপ্রেমের আদর্শের অনুসারী । তিনি ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির প্রমুখের সহযোগী । মননশীল, চিন্তা-উদ্দীপক ও পরিশীলিত গদ্যের রচয়িতা হিসেবে বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে তিনি বিশিষ্ট হয়ে আছেন । তাঁর গ্রন্থ “সংস্কৃতি কথা" বাংলাদেশের প্রবন্ধ-সাহিত্যে এক বিশিষ্ট সংযোজন । তাঁর প্রকাশিত অন্য দুটি গ্রন্থ হচ্ছে ক্লাইভ বেল-এর “Civilization'' গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত “সভ্যতা* এবং বারট্রার্ভ রাসেলের 'Conquest of Happiness', গ্রন্থের অনুবাদ “সুখ'। বাংলা একাডেমি তার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সমস্ত রচনা রচনাবলি-আকারে প্রকাশ করেছে। চট্টথ্রাম কলেজে অধ্যাপনাকালে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


সমাজের কাজ কেবল টিকে থাকার সুবিধা দেওয়া নয়, মানুষকে বড় করে তোলা, বিকশিত জীবনের জন্য মানুষের জীবনে আগ্রহ জাগিয়ে দেওয়া। স্বক্প্রাণ স্থুলবুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষে সংসার পরিপূর্ণ। তাদের কাজ নিজের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা নয়, অপরের সার্থকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করেনি বলে এরা নিষ্ঠুর ও বিকৃতবুদ্ধি। এদের একমাত্র দেবতা অহংকার । তারই চরণে তারা নিবেদিতপ্রাণ। ব্যক্তিগত অহংকার, পারিবারিক অহংকার, জাতিগত অহংকার- এ সবের নিশান ওড়ানোই এদের কাজ। মাঝে মাঝে মানবপ্েমের কথাও তারা বলে। কিন্তু তাতে নেশা ধরে না, মনে হয় আন্তরিকতাশূন্য, উপলব্ধিহীন বুলি।

এদের স্থানে এনে দিতে হবে বড় মানুষ- সুন্ষবুদ্ধি উদারহদয় গভীরচিন্ত ব্যক্তি, যাদের কাছে বড় হয়ে উঠবে জীবনের বিকাশ, কেবল টিকে থাকা নয়। তাদের কাছে জীবনাদর্শের প্রতীক হবে প্রাণহীন ছাচ বা কল নয়, সজীব বৃক্ষ- যার বৃদ্ধি আছে, গতি আছে, বিকাশ আছে, ফুলে ফলে পরিপূর্ণ হয়ে অপরের সেবার জন্য প্রস্তত হওয়া যার কাজ। বৃক্ষের জীবনের গতি ও বিকাশকে উপলব্ধি করা দরকার, নইলে সার্থকতা ও পরিপূর্ণতার ছবি চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না।

বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়। তাই, বারবার সেদিকে তাকানো প্রয়োজন । মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলাতেই বৃক্ষের কাজের সমাপ্তি নয়। তাকে ফুল ফোটাতে হয়, ফল ধরাতে হয়। নইলে তার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই বৃক্ষকে সার্থকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা সজীবতা ও সার্থকতার এমন জীবন্ত দৃষ্টান্ত আর নেই।

মধ্যেই মনুষ্যতের সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছেন । তার মনে মনুষ্যতের বেদনা নদীর গতিতেই উপলব্ধ হয়, ফুলের ফোটায় নয়। ফুলের ফোটা সহজ, নদীর গতি সহজ নয়- তাকে অনেক বাধা ডিানোর দুঃখ পেতে হয় । কিন্তু ফুলের ফোটার দিকে না তাকিয়ে বৃক্ষের ফুল ফোটানোর দিকে তাকালে বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ভালো করতেন। তপোবনপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ কেন যে তা করলেন না বোঝা মুশকিল।

জানি, বলা হবে : নদীর গতিতে মনুষ্যত্বের দুঃখ যতটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৃক্ষের ফুল ফোটানোয় তা তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। তাই কৰি নদীকেই মনুষ্যতের প্রতীক করতে চেয়েছেন।

উত্তরে বলব : চর্মচক্ষুকে বড় না করে কল্পনা ও অনুভূতির চক্ষুকে বড় করে তুললে বৃক্ষের বেদনাও সহজে উপলব্ধি করা যায়। আর বৃক্ষের সাধনায় যেমন একটা ধীরস্থির ভাব দেখতে পাওয়া যায়, মানুষের সাধনায়ও তেমনি একটা ধীরস্থির ভাব দেখতে পাওয়া যায়, আর এটাই হওয়া উচিত নয় কি? অনবরত ধেয়ে চলা মানুষের সাধনা হওয়া উচিত নয়। যাকে বলা হয় গোপন ও নীরব সাধনা তা বৃক্ষেই অভিব্যক্ত, নদীতে নয়। তাছাড়া বৃক্ষের সার্থকতার ছবি যত সহজে উপলব্ধি করতে পারি, নদীর সার্থকতার ছবি তত সহজে উপলব্ধি করা যায় না। নদী সাগরে পতিত হয় সত্য, কিন্তু তার ছবি আমরা প্রত্যহ দেখতে পাই না। বৃক্ষের ফুল ফোটানো ও ফল ধরানোর ছবি কিন্ত প্রত্যহ চোখে পড়ে। দোরের কাছে দীড়িয়ে থেকে সে অনবরত নতি, শান্তি ও সেবার বাণী প্রচার করে।

সাধনার ব্যাপারে প্রাপ্তি একটা বড় জিনিস। নদীর সাগরে পতিত হওয়ায় সেই প্রাপ্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। সেতো প্রাপ্তি নয়, রুহ রিপূর্ য়েওঠে তখন আপনা থেকেই বলতে ইচ্ছা হয় : এই তো সাধনার সার্থকতা বৃক্ষে প্রাপ্তি ও দান। মানুষেরও প্রাপ্তি ও দানে পার্থক্য দেখা যায় না। যা তার প্রাপ্তি তা-ই তার দান।

বৃক্ষের পানে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই অন্তরের সৃষ্টিধর্ম উপলব্ধি করেছেন। বহু কবিতায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্ত গদ্যে তিনি তা স্পষ্ট করে বলেননি। বললে ভালো হতো। তাহলে নিজের ঘরের কাছেই যে সার্থকতার প্রতীক রয়েছে, সে সম্বন্ধে আমরা সচেতন হতে পারতাম ।

নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার গান গেয়ে শোনায় । অনুভূতির কান দিয়ে সে গান শুনতে হবে। তাহলে বুঝতে পারা যাবে জীবনের মানে বৃদ্ধি, ধর্মের মানেও তাই। প্রকৃতির যে ধর্ম মানুষের সে ধর্ম; পার্থক্য কেবল তরুলতা ও জীবজন্তর বৃদ্ধির ওপর তাদের নিজেদের কোনো হাত নেই, মানুষের বৃদ্ধির ওপরে তার নিজের হাত রয়েছে। আর এখানেই মানুষের মর্যাদা । মানুষের বৃদ্ধি কেবল দৈহিক নয়, আত্বিকও । মানুষকে আত্মা সৃষ্টি করে নিতে হয়, তা তৈরি পাওয়া যায় না। সুখ-দুঃখ-বেদনা উপলব্ধির ফলে অন্তরের যে পরিপকৃতা, তাই তো আত্মা। এই আত্মারূপ ফল স্রষ্টার উপভোগ্য ৷ তাই মহাকবির মুখে শুনতে পাওয়া যায় 'Ripeness is all' পরিপকৃতাই সব। আত্মাকে মধুর ও পুষ্ট করে গড়ে তুলতে হবে। নইলে তা স্রষ্টার উপভোগের উপযুক্ত হবে না। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, প্রচুর প্রেম ও গভীর অনুভূতির দ্বারা আত্মার পরিপুষ্টি ও মাধুর্য সম্পাদন সম্ভব। তাই তাদের সাধনাই মানুষের শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্ত। বন্তুজিজ্ঞাসা তথা বিজ্ঞান কখনো শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু হতে পারে না। কেননা, তাতে আত্মার উন্নতি হয় না- জীবনবোধ ও মূল্যবোধে অন্তর পরিপূর্ণ হয় না; তা হয় সাহিত্য-শিল্পকলার দ্বারা । তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের এত মূল্য ।

ওপরে যে বৃদ্ধির কথা বলা হলো বৃক্ষের জীবন তার চমৎকার নিদর্শন । বৃক্ষের অস্কুরিত হওয়া থেকে ফলবান হওয়া পর্যন্ত সেখানে কেবলই বৃদ্ধির ইতিহাস। বৃক্ষের পানে তাকিয়ে আমরা লাভবান হতে পারি_ জীবনের গৃঢ় অর্থ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারি বলে। বৃক্ষ যে কেবল বৃদ্ধির ইশারা তা নয়- প্রশান্তিরও ইঙ্গিত। অতি শান্ত ও সহিষ্ণুতায় সে জীবনের গুরুভার বহন করে। 


পাঠ-পরিচিতি -  মোতাহের হোসেন চৌধুরীর “জীবন ও বৃক্ষ” প্রবন্ধটি তার “সংস্কৃতি কথা গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। পরার্থে আত্মনিবেদিত সুকৃতিময় সার্থক বিবেকবোধসম্পন্ন মানবজীবনের মহত্তম প্রত্যাশা থেকে লেখক মানুষের জীবনকাঠামোকে তুলনা করেছেন বৃক্ষের সঙ্গে। তিনি দেখিয়েছেন, বৃক্ষের বিকাশ, পরিপূর্ণতা ও সার্থকতার পেছনে রয়েছে তার নীরব সাধনা । বৃক্ষ যেমন করে ফুলে ফলে পরিপূর্ণতা পায়, আর সে সব অন্যকে দান করে সার্থকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে, মানব-জীবনের সার্থকতার জন্য তার নিজের সাধনাও তেমনি হওয়া উচিত। সেবায় বিকশিত বিবেকবান পরিপূর্ণ ও সার্থক মানুষ ।


সৃজনশীল প্রশ্ন

এই যে বিটপি শ্রেণি হেরি সারি সারি_

কি আশ্চর্য শোভাময় যাই বলিহারি।

কেহবা সরল সাধু হৃদয় যেমন,

ফলভারে নত কেহ গুণীর মতন।

এদের স্বভাব ভালো মানবের চেয়ে,

ইচ্ছা যার দেখ দেখ জ্ঞানচক্ষে চেয়ে।

যখন মানবকুল ধনবান হয়,


তখন তাদের শির সমুন্নত রয়।

কিন্ত ফলশালী হলে এই তরুগণ,

অহংকারে উচ্চ শির না করে কখন।

ফলশূন্য হলে সদা থাকে সমুন্নত,

নীচ প্রায় কার ঠাই নহে অবনত ।


ক. মোতাহের হোসের চৌধুরী কোন আন্দোলনের কাগ্ডারি ছিলেন?

খ. কৰি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদীকেই মনুষ্যত্ের প্রতীক করতে চেয়েছেন কেন?

গ. “বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয় প্রবন্ধের এ উক্ভিটি উদ্দীপকে কীভাবে

প্রতিফলিত হয়েছে? ব্যাখ্যা কর।

ঘ. “উদ্দীপকের 'বৃক্ষ' এবং “জীবন ও বৃক্ষ” প্রবন্ধের “বৃক্ষ' কি একসূত্রে গাথা?'_ তোমার মতের পক্ষে যুক্তি দাও।


Post a Comment

0 Comments