Latest courses

মানব কল্যাণ - আবুল ফজল

 

লেখক-পরিচিতি - আবুল ফজলের জন্ম ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা জুলাই চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় । তার পিতার নাম ফজলুর রহমান । তিনি চট্টগ্রাম ও ঢাকায় তার শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন । স্কুল শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে প্রায় ত্রিশ বছর কলেজে অধ্যাপনা করেছেন । চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টার দায়িতক পালন করেন তিনি। সমাজ ও সমকাল-সচেতন সাহিত্যিক এবং প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি সমধিক খ্যাত । ছাত্রজীবনেই যুক্ত হন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে; অন্যদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম সাহিত্য সমাজ । কথাশিল্লী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করলেও তিনি ছিলেন মূলত চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক। তার প্রবন্ধে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টির পরিচয় বিধৃত । আধুনিক অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ, স্বদেশ ও এতিহ্যগ্রীতি, মানবতা ও  শুভবোধ তার সাহিত্যকর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় । তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে_ উপন্যাস : “চৌচির", “রাঙা প্রভাত'ঃ গল্পগন্থ : “মাটির পৃথিবী, “মৃতের আত্মহত্যা"; প্রবন্ধ : “সাহিত্য সংস্কৃতি সাধনা", “সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন", “সমাজ সাহিত্য ও রাষ্ট্র, “মানবতন্ত্র, “একুশ মানে মাথা নত না করা”; দিনলিপি : “রেখাচিত্র', “দুর্দিনের দিনলিপি" । সাহিত্যকৃতির জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ মে টট্টগ্রামে তার জীবনাবসান ঘটে ।


মানব-কল্যাণ_ এ শিরোনাম আমার দেওয়া নয় । আমাদের প্রচলিত ধারণা আর চলতি কথায় মানব-কল্যাণ কথাটা অনেকখানি সম্তা আর মামুলি অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এবকমুষ্টি ভিক্ষা দেওয়াকেও আমরা মানব-কল্যাণ মনে করে থাকি । মনুষ্যতৃবোধ আর মানব-মর্ধাদাকে এতে যে ক্ষুণ্ন করা হয় তা সাধারণত উপলব্ধি করা হয় না। 

ইসলামের নবি বলেছেন, ওপরের হাত সব সময় নিচের হাত থেকে শ্রেষ্ঠ। নিচের হাত মানে যে মানুষ হাত পেতে গ্রহণ করে, ওপরের হাত মানে দাতা-_ যে হাত তুলে ওপর থেকে অনুগ্রহ বর্ষণ করে । দান বা ভিক্ষা গ্রহণকারীর দীনতা তার সর্ব অবয়বে কীভাবে প্রতিফলিত হয় তার বীভৎস দৃশ্য কার না নজরে পড়েছে? 

মনুষ্যত্ত আর মানব-মর্যাদার দিক থেকে অনুষ্বহকারী আর অনুগৃহীতের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত । এ কথা ব্যক্তির বেলায় যেমন সত্য, তেমনি দেশ আর রাষ্ট্রের বেলায় বরং অধিকতর সত্য । কারণ, রাষ্ট্র জাতির যৌথ জীবন আর যৌথ চেতনারই প্রতীক।

রাষ্ট্রের দায়িত শুধু প্রশাসন চালানোই নয়, জাতিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলাও রাষ্ট্রের এক বৃহত্তর দায়িতৃ । যে রাষ্ট্র হাতপাতা আর চাট্ুকারিতাকে দেয় প্রশ্রয়, সে রাষ্ট্র কিছুতেই আত্মমর্াদাসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি করতে পারে না। তাই মানব-কল্যাণ অর্থে আমি দয়া বা করুণার বশবর্তী হয়ে দান-খয়রাতকে মনে করি না। মনুষ্যতেের অবমাননা যে ক্রিয়াকর্মের অবশ্যস্তাবী পরিণতি তাকে কিছুতেই মানব-কল্যাণ নামে অভিহিত করা যায় না।

মানব-কল্যাণের উৎস মানুষের মর্যাদাবোধ বৃদ্ধি আর মানবিক চেতনা বিকাশের মধ্যেই নিহিত। একদিন এক ব্যক্তি ইসলামের নবির কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছিল । নবি তাকে একখানা কুড়াল কিনে দিয়ে বলেছিলেন, এটি দিয়ে তুমি বন থেকে কাঠ সংগ্হ করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা রোজগার করো গে। এভাবে তিনি লোকটিতে শুধু স্বাবলম্বনের পথ দেখাননি, সে সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মর্যাদাবান হওয়ার, মর্যাদার সাথে জীবনযাপনের উপায়ও ।

মানুষকে মানুষ হিসেবে এবং মানবিক-বৃত্তির বিকাশের পথেই বেড়ে উঠতে হবে আর তার যথাযথ ক্ষেত্র রচনাই মানব-কল্যাণের প্রাথমিক সোপান । সে সোপান রচনাই সমাজ আর রাষ্ট্রের দায়িতৃ । সমাজের ক্ষুদ্রতম অঙ্গ বা ইউনিট পরিবার- সে পরিবারকেও পালন করতে হয় এ দায়িতৃ । কারণ, মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের সূচনা সেখান থেকেই । ধীরে ধীরে ব্যাপকতর পরিধিতে যখন মানুষের বিচরণ হয় শুরু, তখন সে পরিধিতে যে সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটে- তা শিক্ষা কিংবা জীবিকা সংক্রান্ত যা হোক না তখন সে দায়িতু ধসব প্রতিষ্ঠানের ওপরও বর্তায়। তবে তা অনেকখানি নির্ভর করে অনুকূল পরিবেশ ও ক্ষেত্র গড়ে তোলার ওপর ।

মানব-কল্যাণ স্বয়ন, বিচ্ছিন, সম্পর্ক-রহিত হতে পারে না। প্রতিটি মানুষ যেমন সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, তেমনি তার কল্যাণও সামঘিকভাবে সমাজের ভালো-মন্দের সঙ্গে সংযুক্ত। উপলব্ধি ছাড়া মানব-কল্যাণ স্রেফ দান-খয়রাত আর কাঙালি ভোজনের মতো মানব-মর্ধাদার অবমাননাকর এক পদ্ধতি না হয়ে যায় না, যা আমাদের দেশ আর সমাজে হয়েছে। এসবকে বাহবা দেওয়ার এবং এসব করে বাহবা কুড়োবার লোকেরও অভাব নেই দেশে।

আসল কথা, মানুষের মনুষ্যতকে বাদ দিয়ে স্রেফ তার জৈব অস্তিতের প্রতি সহানুভূতিশীল এ ধরনের মানব-কল্যাণ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হতে পারে না। এ হেন মানব-কল্যাণের কুৎসিত ছবি দেখার জন্য দুরদূরান্তে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাদের আশে-পাশে, চারদিকে তাকিয়ে দেখলেই তা দেখা যায়। বর্তমানে মানব-কল্যাণ অর্থে আমরা যা বুঝি তার প্রধানতম অন্তরায় রাষ্ট্র, জাতি, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত চেতনা- যা মানুষকে মেলায় না, করে বিভক্ত । বিভক্তিকরণের মনোভাব নিয়ে কারো কল্যাণ করা যায় না। করা যায় একমাত্র সমতা আর সহযোগ-সহযোগিতার পথে ।

সত্যিকার মানব-কল্যাণ মহৎ চিন্তা-ভাবনারই ফসল । বাংলাদেশের মহৎ প্রতিভারা সবাই মানবিক চিন্তা আর আদর্শের উত্তরাধিকার রেখে গেছেন । দুঃখের বিষয়, সে উত্তরাধিকারকে আমরা জীবনে প্রয়োগ করতে পারিনি । বিদ্যাপতি চ্টীদাস থেকে লালন প্রমুখ কবি এবং অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে রবীন্ধরনাথ-নজরুল সবাইতো মানবিক চেতনার উদাত্ত কণ্ঠস্বর ৷ বঙ্কিমচন্দ্রের অবিস্মরণীয় সাহিত্যিক উক্তি : “তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?” এক গভীর মূল্যবোধেরই উৎসারণ |

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিম্ললিখিত উক্তিটিও স্মরণীয় : “ Relationship is the fundamental truth of the world of appearance.” কবি এ উক্তিটি করেছিলেন তার হিবার্ট বক্তৃতামালায়। অন্তর-জগতের বাইরে যে জগৎকে আমরা অহরহ দেখতে পাই তার মৌলিক সত্য পারস্পরিক সংযোগ-সহযোগিতা, কবি যাকে Relationship বলেছেন। সে সংযোগ বা সম্পর্কের অভাব ঘটলে মানব-কল্যাণ কথাটা স্রেফ ভিক্ষা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কে পরিণত হয়।

মানব-কল্যাণ অলৌকিক কিছু নয়_- এ এক জাগতিক মানবধর্ম। তাই এর সাথে মানব-মর্যাদার তথা Human dignity-র সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য । আজ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখলে কী দেখতে পাই? দেখতে পাই দুস্থ, অবহেলিত, বাস্তহারা, স্বদেশ-বিতাড়িত মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে চলেছে। সে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে রিলিফ, রিহেবিলিটেশন ইত্যাদি শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ । রেডক্রস ইত্যাদি সেবাধর্মী সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধিই কি প্রমাণ করে না মানব-কল্যাণ কথাটা স্রেফ মানব-অপমানে পরিণত হয়েছে? মানুষের স্বাভাবিক অধিকার আর মর্যাদার স্বীকৃতি আর প্রতিষ্ঠা ছাড়া মানব-কল্যাণ মানব-অপমানে পরিণত না হয়ে পারে না।

কালের বিবর্তনে আমরা এখন আর 01০ বা গোষ্ঠীবদ্ধ জীব নই-_ বৃহত্তর মানবতার অংশ । তাই Go of humanity-কে বিচ্ছিন, বিক্ষিপ্ত কিংবা খাঁ্তভাবে দেখা বা নেওয়া যায় না। তেমনি নেওয়া যায় না তার কল্যাণকর্মকেও খন্তিত করে । দেখতে মানুষও অন্য একটা প্রাণী মাত্র, কিন্তু ভেতরে মানুষের মধ্যে রয়েছে এক অসীম ও অনন্ত সম্ভাবনার বীজ । যে সম্ভাবনার স্কুরণ-স্কুটনের সুযোগ দেওয়া, ক্ষেত্র রচনা আর তাতে সাহায্য করাই শ্রেষ্ঠতম মানব-কল্যাণ। সেটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কিংবা কোনো রকম অপমান-অবমাননার পথে হতে পারে না। হালে যে দর্শনকে অস্তিতৃবাদ নামে অভিহিত করা হয়, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Existentialism তারও মূল কথা ব্যক্তি মানুষের অস্তিতৃকে স্বীকৃতি দান। 

বল প্রয়োগ কিংবা সামরিক শাসন দিয়ে মানুষকে তাবেদার কিংবা চাটুকার বানাতে পারা যায় কিন্তু প্রতিষ্ঠা করা যায় না মানব-মর্যাদার আসনে । সব কর্মের সাথে শুধু যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকে তা নয়, তার সামাজিক পরিণতি তথা Social consequence-ও অবিচ্ছিনন। যেহেতু সব মানুষই সমাজের অঙ্গ, তাই সব রকম কল্যাণ-কর্মেরও রয়েছে সামাজিক পরিণতি । এ সত্যটা অনেক সময় ভুলে থাকা হয় । বিশেষত যখন দৃষ্টি থাকে উর্ধ্ব দিকে তথা পরলোকের পানে।

স্রেফ সদিচ্ছার দ্বারা মানব-কল্যাণ সাধিত হয় না। সব ধর্ম আর ধর্ম-প্রবর্তকেরা বারংবার নির্দেশ দিয়েছেন মানুষের ভালো করো, মানুষের কল্যাণ করো, সুখ-শান্তি দান করো মানুষকে । এমনকি সর্বজীবে হিতের কথাও বলা হয়েছে। অতএব আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে । নতুন পদ্ধতিতে_ যা হবে বৈজ্ঞানিক, র্যাশনাল ও সুবুদ্ধি-নিয়ন্ত্রিত। সমস্যা যত বড় আর যত ব্যাপকই হোক না তার মোকাবেলা করতে হবে সাহস আর বুদ্ধিমত্তার সাথে । এড়িয়ে গিয়ে কিংবা জোড়াতালি দিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান করা যায় না।

আমাদের বিশ্বাস মুক্তবুদ্ধির সহায়তায় সুপরিকল্পিত পথেই কল্যাণময় পৃথিবী রচনা সম্ভব। একমাত্র মুক্ত বিচারবুদ্ধির সাহায্যেই বিজ্ঞানের অভাবনীয় আবিষ্কারকে ধ্বংসের পরিবর্তে সৃজনশীল মানবিক কর্মে করা যায় নিয়োগ । তা করা হলেই মানব-কল্যাণ হয়ে উঠবে মানব-মর্যাদার সহায়ক। (সংক্ষেপিতা


পাঠ-পরিচিতি - আবুল ফজলের “মানব-কল্যাণ” প্রবন্ধটি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে রচিত। এটি প্রথম “মানবতন্ত্র গ্রন্থে সংকলিত হয়। এই রচনায় লেখক মানব-কল্যাণ ধারণাটির তাৎপর্য বিচারে সচেষ্ট হয়েছেন। সাধারণভাবে অনেকে দুষ্থ মানুষকে করুণাবশত দান-খয়রাত করাকে মানব কল্যাণ মনে করেন । কিন্তু লেখকের মতে, এমন ধারণা খুবই সংকীর্ণ মনোভাবের পরিচায়ক ৷ তার মতে, মানব-কল্যাণ হলো মানুষের সার্বিক মঙ্গলের প্রয়াস। এ কল্যাণের লক্ষ্য সকল অবমাননাকর অবস্থা থেকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থায় মানুষের উত্তরণ ঘটানো। লেখকের বিশ্বাস, মুক্তবুদ্ধির সহায়তাই পরিকল্পনামাফিক পথেই কল্যানময় পৃথিবী রচনা করা সম্ভব। 


সৃজনশীল প্রশ্ন - 

আমার একার সুখ, সুখ নহে ভাই,

সকলের সুখ, সখা, সুখ শুধু তাই।

আমার একার আলো সে যে অন্ধকার,

যদি না সবারে অংশ দিতে পাই।

যাইব কাহারে বল; ফেলিয়া পশ্চাতে ।

এক সাথে বাচি আর এক সাথে মরি,

এসো বন্ধু, এ জীবন সুমধুর করি ।


ক. “ওপরের হাত সব সময় নিচের হাত থেকে শ্রেষ্ঠ'_ কথাটি কে বলেছেন?

খ. “রাষ্ট্র জাতির যৌথ জীবন আর যৌথ চেতনারই প্রতীক'_ উক্তিটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?

গ. কবিতাংশটি “মানব-কল্যাণ” প্রবন্ধের কোন দিকটিকে প্রতিফলিত করেছে? ব্যাখ্যা কর।

ঘ. কবিতাংশটি “মানব-কল্যাণ” প্রবন্ধের আংশিক প্রতিচ্ছবি- তোমার মতের পক্ষে যুক্তি দাও।

Post a Comment

9 Comments

  1. বহু নির্বাচনী প্রশ্ন কোথায়?

    ReplyDelete
  2. গাইড এ যে ভাবে এই অধ্যার প্রশ্ন দেওয়া থাকে ওই ভাবে কিছু প্রশ্ন দিতেন

    ReplyDelete
  3. প্রশ্ন দিয়ে রাখছেন,,, উওর কে দিবে??

    ReplyDelete
  4. উত্তর কি আমার নানা দিবে ???

    ReplyDelete