Latest courses

নাটক

 

নাটক

উদ্দেশ্য

এই পাঠ শেষে আপনি-

 নাটকের সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করতে পারবেন।

 নাটকের গঠনকৌশল সম্পর্কেধারণা ব্যক্ত করতে পারবেন।

 নাটকের রূপগত বৈচিত্র্য সম্পর্কেলিখতে পারবেন।

 নাটকের শ্রেণীবিভাগ করতে পারবেন।

 নাটক সম্পর্কেনাট্যতত্ত¡বিদ এ্যারিস্টটলের ধারণা লিখতে পারবেন।

 বাংলা নাটকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখতে পারবেন।

সংজ্ঞার্থ

সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিক বা রূপের (Form) মধ্যে নাটক কবিতার মতোই প্রাচীন। ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রেনাটককে কবিতারই একটি রূপ ‘দৃশ্যকাব্য’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। যেখানে কবিতাকে বলা হয়েছে ‘শ্রব্যকাব্য’। নাটকে ঘটনা, চরিত্র, চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আচার-আচরণ উচ্চারিত সংলাপের মাধ্যমে রূপ লাভ করে। এ-ক্ষেত্রে নাটকের বিষয়বস্তু, পাত্র-পাত্রী এবং দর্শকের যৌথ উপস্থিতিতে এটি হয়ে ওঠে সামবায়িক শিল্প। অন্যদিকে কবিতা মূলত শ্রæতিনির্ভর। প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যতাত্তি¡ক এ্যারিস্টটলের Poetics বা কাব্যতত্ত¡ গ্রন্থে প্রধানত নাটকেরই বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হয়েছে। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে মানুষের রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নাটকের রূপ-রীতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন অনিবার্যকরে তুলেছে। কিন্তুনাটকের মৌলিক উপকরণ  অভিনেতা-অভিনেত্রী, মঞ্চ এবং দর্শক-শ্রোতা  অভিন্নই রয়ে গেছে।

মানুষের জীবন সরলরেখায় শান্ত-স্বছন্দ ভঙ্গিতে প্রবাহিত হয় না। এ-ধরনের জীবন থাকলেও তা নাটকীয়তা বর্জিত। মানুষের জীবনের ছন্দ ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে প্রবহমান। দুর্ভোগ, যন্ত্রণা, বিক্ষোভ, অশান্তিপ্রভৃতির আকস্মিক আঘাতে মানুষের জীবনে গতি ও বৈচিত্র্য অনিবার্যহয়ে ওঠে। জীবনের এই গতি ও বৈচিত্র্যকে শিল্পে ধারণ করার প্রয়োজন থেকেই নাটকের উদ্ভব। মহৎ চেষ্টার নিষ্ফলতা, প্রাণান্তকর পরিশ্রমের ব্যর্থতা, অপ্রত্যাশিত ভাগ্যবিপর্যয়, বিচিত্র ঘটনার চমকপ্রদ সমাপতন, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের বিশ্বাসঘাতকতা, দ্বেষ-ঈর্ষা, কঠিন সংগ্রাম ও তার শোকাবহ পরাজয়, মনের গভীরে বিরুদ্ধ-প্রবৃত্তির সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম  এই সব নাটকীয় উপাদান বা নাটকীয়তা রয়ে গেছে মানুষের জীবন ও তার স্বভাবের মধ্যেই। নাট্যকার নাটক রচনার সময় জীবনের উলিখিত উপাদানগুলোই গ্রহণ করে থাকেন।

কিন্তু উপাদানগুলোকে গ্রহণ করলেই যথার্থ নাটক হবে না। নির্দিষ্ট শিল্প-শৃঙ্খলায় কোনো একটি উপাদান বা একাধিক উপাদানের বিন্যাসই সার্থক নাটকের জন্ম দেয়। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো নাটকেরও রয়েছে রূপ-রীতিগত নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ পাঠ ও উপভোগের জন্য মানুষের অন্য ব্যক্তি বা সহশক্তির প্রয়োজন হয় না। কিন্তুকেবল পাঠ করে নাটক উপভোগ করা যায় না। নাটক যথার্থভাবে উপভোগ করতে হলে একটি সামবায়িক বা যৌথ পরিবেশের প্রয়োজন। অভিনেতা-অভিনেত্রী, মঞ্চ এবং দর্শক-শ্রোতা  এসবের দিকে লক্ষ রেখেই নাট্যকার নাটক রচনা করেন। কেবল পাঠ করে নাটকের যে উপভোগ  তা আংশিক। উপভোগকে সমগ্র হয়ে উঠতে হলে নির্দিষ্ট সময়ে ও স্থানে সম্মিলিতভাবে নাটক উপস্থাপন ও দর্শন করতে হয়। এ জন্যেই নাটকের শিল্পীরীতি যথেষ্ট সতর্ক, দৃঢ়বদ্ধ, কঠোর এবং নিয়মতান্ত্রিক। সময়ের বিবর্তনে নাটকের রূপ-রীতির ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু নিয়মের অনুশাসনের মধ্যে থেকেই রূপরীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন নাট্যকাররা। প্রাচীন গ্রীক-রোমান নাটক, এলিজাবেথান যুগের কালজয়ী নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়রের নাটক কিংবা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বিচিত্র উপাদানে তৈরি নাটকসমূহ বিশেষণ করলে উপর্যুক্ত মন্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। নিয়ম ও রূপরীতির অনুশাসনের ফলেই নাটকের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা হয়ে উঠেছে প্রায়োগিক শিল্পমাধ্যম বা Performing Art । 


নাটকের পট বা ঘটনাংশ

এ্যারিস্টটল তাঁর Poetics গ্রন্থে নাটকের ছয়টি অঙ্গের কথা বলেছেন: ১. পট বা বৃত্ত ২. চরিত্র ৩. রচনারীতি ৪. ভাব, ৫. দৃশ্য এবং ৬. সঙ্গীত। এগুলোর মধ্যে পট বা বৃত্তই প্রধান। মানবজীবনে ঘটে যাওয়া বিচিত্র ঘটনার মধ্য থেকে নাট্যকার নাটকের উপাদান আহরণ করেন। নাটকের ঘটনাংশ বিভিন্ন অঙ্কে বিভক্ত থাকে। বিভিন্ন অঙ্কে নাটকের গতি চরিত্রের ফর্ম বা অ্যাকশন অনুযায়ী গতি পায়। গ্রীক ট্র্যাজেডিতে এই গতি চরম লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হয়। শেক্সপীয়রের নাটকের ঘটনাংশ পঞ্চাঙ্ক বিভাগের মাধ্যমে উপস্থাপিত। প্রত্যেক অঙ্কে ঘটনা এক-একটি বাঁক নেয়। এভাবে ঘটনার গতি উত্থান, চরমোন্নতি ও পতনের মধ্য দিয়ে পরিণামের দিকে ধাবিত হয়। নাটকের Plot বা বৃত্তের বিন্যাস-কৌশলের উপরই নির্ভর করে নাটকের শিল্পসার্থকতা। নাটকে পট বা বৃত্ত যে বিষয়বস্তুকে ধারণ করবে, এ্যারিস্টটলের মতে, সেখানে আদি, মধ্য, অন্ত এই তিনটি পর্ব- বিভাজন থাকবে। তাঁর মতে নাটকের কাহিনী দুই রকম:

১. সরল (Simple)

২. জটিল (Complex)

যে-নাটকে ঘটনার ধারা অবিচ্ছিন্ন, তার পটকেই বলা হবে সরল। কিন্তু মানুষের জীবনে এই সরল রৈখিক অবিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়াও রয়েছে এক গভীর, জটিল পর্যায়। যে-সব নাটকের ঘটনার মধ্যে বিপর্যয় বা অভ‚তপূর্বধারণা, বোধ কিংবা ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্কনতুন চিন্তার প্রতিফলনে বিশিষ্ট (Reversal of Situation or Recognition or by Both) হয়ে ওঠে, সে-সব নাটকের চরিত্র ভালো-মন্দ বা ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বাঁক পরিবর্তন করে। এই বাঁক পরিবর্তনে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা মানবিক অবস্থার পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা পরিস্থিতির বিপর্যয় নাটকের ঘটনাকে কতোটা জটিল করে তুলতে পারে, সফোক্লিসের কালজয়ী ট্র্যাজেডি ‘ইডিপাস’ তার প্রমাণ। নাটকের ঘটনার পরিণতি আনন্দদায়ক হলে তাকে বলে কমেডি (Comedy)। আবার চরম দুঃখবহ হলে তাকে বলা হয় ট্র্যাজেডি (Tragedy)। সফোক্লিস এবং শেক্সপীয়রের অধিকাংশ নাটকই পটবিন্যাস এবং বিষয়ভাবনায় ট্র্যাজেডির পর্যায়ে পড়ে। সমাজ ও সভ্যতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাটকের পট ও বিষয়বিন্যাসে প্রচুর রূপান্তর ঘটেছে। কিন্তুজীবনকে উপস্থাপনে সরল ও জটিল  এই দুই ভঙ্গির প্রাধান্য এখনো আছে। এ্যারিস্টটল সার্থক নাটকের জন্য তিনটি ঐক্যের উপর জোর দিয়েছেন। সে গুলো হচ্ছে  সময়ের ঐক্য, ঘটনার ঐক্য এবং স্থানের ঐক্য। এই ঐক্যের ধারণা অনেক পাল্টেছে বটে, কিন্তুসময়ের ভেতর-বাইরের শৃঙ্খলা এখনো একটি সার্থক নাটক হয়ে-উঠার অন্যতম মানদন্ড। 

চরিত্র

নাটক মানব জীবনের রূপায়ণ। এ-জীবন ক্রিয়াশীল এবং বহুস্তরীভ‚ত। সুতরাং চরিত্রই নাটকের মূল উপাদান। মানবচরিত্রের রূপ ও প্রকৃতি বিচিত্র, যেমন সৎ-অসৎ, সরল-জটিল, আত্মসচেতন, স্বাবলম্বী অথবা পরিস্থিতির কাছে আত্মসমপর্ণকারী ইত্যাদি। মানবজীবন রূপায়ণের প্রয়োজনে যে কোন ধরনের চরিত্র নাট্যকার বেছে নিতে পারেন।্ নাটকীয় চরিত্রকে চারটি বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করেছেন এ্যারিস্টটল। তাঁর মতে নাটকীয় চরিত্র মূলত কতকগুলো নৈতিক আচরণের সমষ্টি বা প্রতিনিধি মাত্র। এ্যারিস্টটলের মতে, এই আচরণের ভিত্তিতেই নাটকের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে হবে।

প্রথমত: মানুষের চরিত্র ভালো (Good Character) হতে পারে। কিন্তু অবিমিশ্র ভালো চরিত্র নাটকে কোনো জটিলতা বা সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে না। নাটকীয় চরিত্র হবে ভালো-মন্দের সংমিশ্রণের ফল। এ্যারিস্টটলের মতে ট্রাজেডির চরিত্র হবে ভালো-মন্দের মাঝামাঝি।

দ্বিতীয়ত: নাটকে চরিত্রের যথাযথ প্রকাশ (Appropiateness) ঘটবে।

তৃতীয়ত: চরিত্রকে হতে হবে বাস্তবসম্মত (Real)

চতুর্থত: চরিত্রের সঙ্গতিপূর্ণআচরণ (Consistent)।

চরিত্রের আচরণে অসামঞ্জস্য থাকলে শিল্পের ক্ষেত্রে তা হবে সঙ্গতিহীন (Consistently Inconsistent)। এ্যারিস্টটলের এই দৃষ্টিভঙ্গি নাটকের চিরকালের বৈশিষ্ট্যকেই যেন নির্দেশ করেছে। সমাজজীবনের পরিবর্তন মানুষের বোধকেও পরিবর্তিত করেছে। ভালো মন্দের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। মন্দচরিত্রও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাটকে বিধৃত হয়েছে। কিন্তু মনুষ্যত্বের লক্ষণবর্জিত কোনো চরিত্র, যে মানুষের সহানুভ‚তি আকর্ষণে ব্যর্থ  তাকে কখনোই নাটকীয় চরিত্র বলা যাবে না।  রিবর্তনশীল সমাজ ও জীবন নাটকের চরিত্রের আকৃতি-প্রকৃতির বদলও অনিবার্য করে তুলেছে। ইউরোপের রেনেসাঁস থেকে শুরু করে গণতন্ত্রের আবির্ভাব ও চর্চা নাটকের চরিত্র ও তার স্বভাবকেও পরিবর্তন করেছে। রাজতন্ত্রও সামন্ততন্ত্রের অন্ধকার যুগ থেকে কেবল নাটক নয়, নাটকের চরিত্রও বের হয়ে এসেছে। ইডিপাসের মতো অসাধারণ চরিত্র হয়তো এখন নেই। কিন্তু সাধারণ মানবজীবন থেকে আহৃত চরিত্র-পাত্রদের জীবনেও যে জটিল চিন্তা, তীক্ষ জিজ্ঞাসা, দ্ব›দ্ব, অন্তর্যন্ত্রণা, দুঃখবোধ প্রভৃতি বিদ্যমান আধুনিক নাট্যকাররা তাকেই রূপদান করেন নাটকে।

এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, নাটকের সবগুলো উপাদানের যথাযথ প্রয়োগ কোনো নাটককে সফল করে তোলে। পট বা ঘটনা এবং চরিত্রের পারস্পরিক সংযোগ ও সামঞ্জস্যই নাটকীয়তা সৃষ্টির নিয়ামক। কিন্তুঘটনা ও চরিত্রের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আপেক্ষিক। কোনো নাটকে ঘটনা আবার কোনো নাটকে চরিত্র প্রাধান্য পায়। জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রাধান্য ট্র্যাজেডিকে করেছে চরিত্রপ্রধান। সংগ্রামশীল মানবজীবন, তার দ্ব›দ্ব ও বেদনার বাহন হিসেবে ঘটনার গুরুত্ব সর্বাধিক। কমেডি জীবনের বাইরের অসঙ্গতিকে কৌতুকময় করে প্রকাশ করে বলে সেখানে ঘটনা প্রাধান্য পায়। আধুনিক কালের কোনো কোনো নাটকে নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সমাজ, মানুষের অস্তিত্ব, ব্যক্তিমানুষ প্রভৃতি গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয়েছে।

সংলাপ

সাহিত্যের অন্যান্য শাখা থেকে নাটকের পৃথক অবস্থানের কারণ এই সংলাপ। কেবল চরিত্রের কথা নয়, নাট্যকারের রসসৃষ্টি ও আইডিয়ার বাহনও এই সংলাপ। সংলাপের সার্থকতা নির্ভর করে পরিবেশ ও চরিত্রের মনোভাবের সঙ্গতির উপর। চরিত্রের ব্যক্তিত্ব কিংবা ব্যক্তিত্বহীনতা ফুটিয়ে তোলে এই সংলাপ। চরিত্রের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে হলে তার বাকভঙ্গির বিশিষ্টতা থাকতে হবে। যেমন দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ নাটকের নিমচাঁদের সংলাপ। তার মেধা, ব্যক্তিত্ব কিংবা ব্যক্তিত্বশূন্যতার বাহন তার ইংরেজি-প্রভাবিত সংলাপ। সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘বহিপীর’ নাটকের সংলাপ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপকেই ফুটিয়ে তোলে। সংলাপের ভাষা-বৈচিত্র্য কেবল চরিত্রের স্বাতন্ত্র্যকে প্রকাশ করে না, নাট্যকারের স্বভাবধর্মকেও প্রকাশ করে।

নাটকের শ্রেণীবিভাগ

নাটকের বিষয় ও পরিণতি বিচার করে নাটককে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে:

১. ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্তক নাটক

২, কমেডি বা মিলনান্তক নাটক

৩. প্রহসন

দ্ব›দ্বময় পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও পরিস্থিতির জটিলতায় পরাভ‚ত মানবজীবনের করুণ কাহিনী ট্রাজেডির উপজীব্য। মিলানান্তক হলেও প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার, আকা ক্ষার সঙ্গে প্রাপ্তির এবং উদ্দেশ্যের সঙ্গে উপায়ের দ্ব›দ্ব অথবা বলা যায় মানবকর্মের অসঙ্গতি ট্র্যাজেডির মতো কমেডিরও উপজীব্য। কমেডিকে কয়েকটি প্রধান শ্রেণীভুক্ত করা যায়। যেমন কাব্যধর্মী বা রোম্যান্টিক কমেডি, সামাজিক কমেডি, চক্রান্তমূলক কমেডি প্রভৃতি। আবার কোনো কোনো সমালোচক কমেডিকে কল্পনাত্মক, ভাবপ্রবণ, বাস্তববাদী, বিদ্রƒপাত্মক, সামাজিক ভাবপ্রধান প্রভৃতি ধারায় চিহ্নিত করেছেন। এছাড়াও রয়েছে নাটকের ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক রূপের দুই বহিচর্বিত ধারা। ছকের সাহায্যে নাটকের শ্রেণীবিভাগের বৈচিত্র্য নির্দেশ করা যেতে পারে:



এছাড়াও আধুনিককালে সংযোযিত হয়েছে একাঙ্ক নাটক।

বাংলা নাটকের ইতিহাস

উপন্যাস ও ছোটগল্পের মতো বাংলা নাটকেরও সূত্রপাত ঊনবিংশ শতাব্দীতে। কিন্তুনাটকের ঐতিহ্য ও সূত্র বাঙালিজীবনে আদিকাল থেকেই ছিলো। যাত্রা, পালাগান, কবিগান এমনকি মঙ্গলকাব্যগুলোর মধ্যেও নাট্যরীতির যথেষ্ট নিদর্শন বিদ্যমান। উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শেআসার ফলে সচেতনভাবে বাংলা নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন শুরু করে। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তুএর বেশ আগে থেকেই বাংলা ভাষায় নাটক রচনা ও মঞ্চস্থহতে শুরু করে। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয় যোগেন্দ্রচন্দ্রগুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ এবং তারাচরণ সিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার নতুন বাজারে রামজয় বসাকের বাড়িতে অভিনীত হয় রামনারায়ণ তর্করতেœর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’।

বাংলা ভাষার প্রথম পর্যায়ের উলেখযোগ্য নাট্যকাররা হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) অমৃতলাল বসু (১৮৫৩-১৯২৯), গিরিশচন্দ্রঘোষ (১৮৪৪-১৯১১), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯- ১৯২৬) প্রমুখ। মাইকেল মধুসূদনের ‘রতœাবলী’ নাটক ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত হয়। তাঁর মঞ্চস্থনাটকগুলোর মধ্যে ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৮), ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১), ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৫৯) উলেখযোগ্য। বাংলা নাটকের সমৃদ্ধি ঘটে মীর মশাররফ হোসেন, ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ নাট্যশিল্পীদের হাতে। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা নাটকের গতি ও ঐশ্বর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পায় নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর চেষ্টায়। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৯২-১৯৬১), শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭০) এবং বিজন ভট্টাচার্য (১৯১৫-১৯৭৭) পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে বাংলা নাটকে বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব আনেন। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় মঞ্চায়িত হওয়ার মধ্যদিয়ে বাংলা নাটক এক নতুন জগতে প্রবেশ করে।

বাংলাদেশের নাটক

অন্যান্য সাহিত্য-আঙ্গিকের মতো বাংলাদেশের নাটকেরও স্বতন্ত্রযাত্রাপথ চিহ্নিত হয় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এ-ভ‚খন্ডের স্বতন্ত্রজীবনরুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা-রূপায়ণে দেশবিভাগ-পূর্বকাল থেকেই যাঁরা নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন, তাঁদের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫) ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৯), আকবরউদ্দীন (১৮৯৫-১৯৭৮), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), শওকত ওসমান (১৯১৮-১৯৯৮) প্রমুখ উলেখযোগ্য। এঁদের হাতেই বাংলাদেশের নাটকের স্বতন্ত্রভিত্তি তৈরি হয়। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর যাঁরা নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন তাঁদের মধ্যে নূরুল মোমেন (১৯০৮-১৯৮৯), সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ (১৯২২-১৯৭১), মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১), আসকার ইবনে সাইখ (জন্ম-১৯২৫) উলেখযোগ্য। নুরুল মোমেনের ‘নেমেসিস’ (১৯৪৮) ও ‘নয়াখান্দান’ (১৯৬২), সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘বহিপীর’ (১৯৬০) ও ‘তরঙ্গভঙ্গ’ (১৯৬৪); মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ (১৯৬২), ‘বিধি’ (১৯৬৬), ও ‘কবর’ (১৯৬৬) বাংলা নাট্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে কালজয়ী সংযোজন হিসেবে বিশিষ্ট। এছাড়া জসীমউদদীন, আজিমউদ্দীন আহমদ, রাজিয়া খান, আবদুল হক, সৈয়দ মকসুদ আলী, ফররুখ আহমদ, আনিস চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মমতাজউদ্দিন আহমদ বিষয়বস্তুও আঙ্গিক-নিরীক্ষার বাংলাদেশের নাটককে বহুগুণে সমৃদ্ধ করেছেন। 

স্বাধীনতা-উত্তরকালে (১৯৭১-১৯৯৯) পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিক থেকে নাটক যে সাফল্য অর্জন করেছে, গুণ ও মানবিচারে তা অন্যান্য সাহিত্য-শাখাগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। স্বাধীনতার অব্যবহিত-পূর্বেযাঁরা নাটক রচনা শুরু করেন, স্বাধীনতার পর তাঁদের হাতেই বাংলাদেশের নাটক সমৃদ্ধি লাভ করে। নাটকের বিষয়ভাবনা পটবিন্যাস এবং চরিত্রচিত্রণের ক্ষেত্রে এই সব নাট্যকারগণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেন। মমতাজউদ্দিন আহমদ এবং সাঈদ আহমদ এ-ক্ষেত্রে স্মরণীয় নাট্যকার। স্বাধীন বাংলাদেশের নাটক যাঁদের সাধনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁদের মধ্যে আবদুলাহ আল মামুন, সেলিম আল দীন, মামুনুর রশীদ, সৈয়দ শামসুল হক এবং জিয়া হায়দারের নাম বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। 

বস্তুসংক্ষেপ: নাটকে ঘটনা, চরিত্র, চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আচার-আচরণ উচ্চারিত সংলাপের মাধ্যমে রূপ লাভ করে। এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু, পাত্র-পাত্রী এবং দর্শকের যৌথ উপস্থিতিতে এটি হয়ে ওঠে সমবায়িক শিল্প। মানুষের জীবন সরলরেখায় শান্ত-স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে প্রবাহিত হয় না। এ-ধরনের জীবন থাকলেও তা নাটকীয়তা বর্জিত। মানুষের জীবন ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে প্রবহমান। দুর্ভোগ, যন্ত্রণা, বিক্ষোভ, অশান্তিপ্রভৃতির আকস্মিক আঘাতে মানুষের জীবনে গতি ও বৈচিত্র্য অনিবার্যহয়ে ওঠে। জীবনের এই গতি ও বৈচিত্র্যকে শিল্পে ধারণ করার প্রয়োজন থেকেই নাটকের উদ্ভব। 

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন
১. নাটক কাকে বলে?
২. নাটকের পট বলতে আমরা কি বুঝি?
৩. নাটকের শ্রেণীকরণ করুন।
৪. ট্র্যাজেডি বলতে আমরা কি বুঝি?

১ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্নের নমুনা-উত্তর:
সংলাপ নাটকের অন্যতম বিশিষ্ট একটি লক্ষণ যা সাহিত্যের অন্যান্য শাখা থেকে নাটককে পৃথক করেছে। চরিত্রের মুখ থেকে উচ্চারিত হলেও সংলাপে নাট্যকারের জীবন-দৃষ্টিরই প্রতিফলন ঘটে। একটি নাটকে বিভিন্নধরনের চরিত্র থাকে। তারা একই ভাষায় কথা বলে না। তাদের সামাজিক, শ্রেণীগত কিংবা বৃদ্ধিবৃত্তিগত অবস্থান নির্দেশিত হয় তাদের উচ্চারিত সংলাপে। যে কারণে আদিকাল থেকেই নাট্যকার সংলাপকে কেবল নাটকের নয়, চরিত্রের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য নিরূপণের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। 

Post a Comment

0 Comments