Latest courses

গৃহ - রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

 


লেখক-পরিচিতি - রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে জনুগ্ঘহণ করেন । তার পিতার নাম জহিরউদ্দীন আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা চৌধুরী । তার প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন এবং বৈবাহিক সূত্রে নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রোকেয়ার পিতা বহু ভাষায় সুপন্তিত হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল । বড়ভাই-বোনের সাহচর্ে রোকেয়া বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ভালোভাবেই রপ্ত করেন এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। ১৮৯৮ সালে উ্দু্ভাষী ও বিপত্বীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তার  জ্ঞানার্জনের পথ অধিকতর সুগম হয় । বিরূপ সমালোচনা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মুখেও তিনি কখনই নারীশিক্ষার লক্ষ্য থেকে সরে আসেন নি; বরং পর্দাপ্রথা ও শিক্ষাবিমুখ মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। রোকেয়া বাংলা গদ্যের বিশিষ্ট শিল্পী। সমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার জন্য তিনি অসাধারণ পান্তিত্যপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী গদ্য রচনা করেন। তাঁর সব রচনাই সমাজ জীবনের গভীর উপলব্ধি থেকে উৎসারিত । 'মতিচুর' ও “অবরোধবাসিনী" তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ গদ্যরন্থ। এছাড়া সুলতানার স্বপ্ন ও 'পদ্রাগ' নামে দুটি উপন্যাসও তিনি রচনা করেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে ।


--- গৃহ বলিলে একটা আরাম বিরামের শান্তি-নিকেতন বুঝায়- যেখানে দিবাশেষে গৃহী কর্মাত্ত শ্রান্ত অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়া বিশ্রাম করিতে পারে । গৃহ গৃহীকে রৌদ্র বৃষ্টি হিম হইতে রক্ষা করে। পশু পক্ষীদেরও গৃহ আছে। তাহারাও স্ব স্ব গৃহে আপনাকে নিরাপদ মনে করে ।

পিপাসা না থাকিলে জল যেমন উপাদেয় বোধ হয় না, সম্ভবত সেইরূপ গৃহ ছাড়িয়া কতকদিন বিদেশে না থাকিলে গৃহসুখ মিষ্টি বোধ হয় না। পুরুষেরা যদিও সর্বদা বিদেশে যায় না, তবু সমস্ত দিন বাহিরে সংসারক্ষেত্রে থাকিয়া অপরাহ্ছে গৃহে ফিরিয়া আসিবার জন্য উৎসুক হয়- বাড়ি আসিলে যেন হাফ ছাড়িয়া বাচে। এখন আমাদের গৃহ সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলিতে চাই । আমাদের সামাজিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখি, অধিকাংশ ভারত নারী গৃহসুখে বঞ্চিতা । যাহারা অপরের অধীনে থাকে, অভিভাবকদের বাটাকে আপন ভবন মনে করিতে যাহাদের অধিকার নাই, গৃহ তাহাদের নিকট কারাগার তুল্য বোধ হয়। পারিবারিক জীবনে যে সুখী নহে, সে নিজেকে পরিবারের একজন গণ্য বলিয়া মনে করিতে সাহসী নহে, তাহার নিকট গৃহ শান্তিনিকেতন বোধ হইতে পারে না । কুমারী, সধবা, বিধবা- সকল শ্রেণির অবলার অবস্থাই শোচনীয় । প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটি অন্তঃপুরের একটু একটু নমুনা দিতেছি। এরূপে অন্তঃপুরের পর্দা উঠাইয়া ভিতরের দৃশ্য দেখাইলে আমার ভ্রাতৃগণ অত্যন্ত ব্যথিত হইবেন, সন্দেহ নাই।

আমরা একবার (বেহারে) জামালপুরের নিকটবর্তী কোন শহরে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। সেখানে আমাদের জনৈক বন্ধুর বাড়ি আছে। সে বাটীর পুরুষের সহিত আমাদের আত্তীয় পুরুষদের বন্ধুত আছে বলিয়া শরাফত মিষ্টভাষিণী, যদিও কুপমণ্ডুক! তাহারা আমাদের যথোচিত অভ্যর্থনা করিলেন । সেখানে শরাফতের পত্রী হসিনা, ভগ্মী জমিলা, জমিলার কন্যা ও পুত্রবধূ প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর জমিলাকে যখন আমাদের বাসায় যাইতে অনুরোধ করিলাম, তখন তিনি বলিলেন যে তাহারা কোন কালে বাড়ির বাহির হন না, ইহাই তাহাদের বংশগৌরব ৷ কখনও ঘোড়ার গাড়ি বা অন্য কোন যানবাহনে আরোহণ করেন নাই । আমি সবিস্ময়ে বলিলাম, “তবে আপনারা বিবাহ করিয়া শ্বশুরবাড়ি যান কিরূপে? আপনার ভ্রাত্বধূ আসিলেন কি করিয়া?” জমিলা উত্তর দিলেন, “ইনি আমাদের আত্রীয়-কন্যা- এ পাড়ায় কেবল আমাদেরই গোষ্ঠীর বাড়ি পাশাপাশি দেখিবে ।” এই বলিয়া তিনি আমাকে অন্য একটা ঘরে লইয়া গিয়া বলিলেন, “এই আমার কন্যার বাড়ি; এখন আমার বাড়ি চল ।” তিনি আমাকে একটা অপ্রশস্ত গলির ভিতর দিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া লইয়া গেলেন। তাহার সকলগুলি কক্ষ দেখাইলেন। কক্ষগুলি “*অসূ্যম্পশ্য” বলিয়া বোধ হইল। অতঃপর একটি দ্বার খুলিলে দেখিলাম অপরদিকে হসিনার পুত্রবধূ আছে! - জমিলা বলিলেন, “দেখিলে এই ছ্বারের ওপারে আমার ভাইয়ের বাড়ি, এপার্ষে আমার বাড়ি । ও কক্ষে বধূ থাকেন বলিয়া এ দ্বারটি বন্ধ রাখি। আমাদের সওয়ারির দরকার হয় না কেন, তাহা এখন বুঝিলে?” এঁরূপে সকল বাড়িই প্রদক্ষিণ করা যায়।

পাঠিকা কি মনে করেন যে হসিনা বা জমিলা গৃহে আছেন? অবশ্য নাঃ কেবল চারি প্রাটারের ভিতর থাকিলেই গৃহে থাকা হয় না। এদেশে বাসরঘরকে “'কোহ্বর” বলে, কিন্ত “কবর” বলা উচিত!! বাড়িখানা ত শরাফতের, সেখানে যেমন এক পাল ছাগল আছে, হংস কুকুট আছে, সেইরূপ একদল স্ত্রীলোকও আছেন! অথবা স্ত্রীলোকদের “*বন্দিনী” বলা যাইতে পারে!

সাধারণত পরিবারের প্রধান পুরুষটি মনে করেন গৃহখানা কেবল “আমার বাটী”- পরিবারস্থ অন্যান্য লোকেরা তাহার আশ্রিতা। মালদহে কয়েকবার আমরা এক বাটাতে যাতায়াত করিয়াছি। গৃহস্বামী কলিমের স্ত্রীকে আমরা কখনও প্রফুল্লুমুখী দেখি নাই । তীহার স্লান মুখখানি নীরবে আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি আকর্ষণ করিত । ইহার কারণ এই- কয় বৎসর অতীত হইল, কলিম স্বীয় ভায়রা ভাইয়ের সহিত বিবাদ করিয়াছেন; তাহার ফলে কলিমের পত্রী স্বীয় ভন্মীর সহিত দেখা করিতে পান না! তিনি এতটুকু ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া বলিতে পারেন না, “আমার ভগ্নী আমার নিকট অবশ্য আসিবেন।” হায়! বাটী যে কলিমের! তিনি যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন, যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন না! আবার ওদিকে ও বাটীখানা সলিমের! সেখানে কলিমের পত্বীর প্রবেশ নিষেধ!

বলা বাহুল্য কলিমের স্ত্রীর অন্ন, বস্ত্র বা অলংকারের অভাব নাই। বলি, অলংকার কি পিতৃমাতৃহীনা অবলার একমাত্র ভগ্নীর বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা ভুলাইতে পারে? শুনিলাম, তিনি সপত্ী-কণ্টক হইতেও বিমুক্ত নহে! এরূপ অবস্থায় তাহার নিকট গৃহ কি শান্তিনিকেতন বলিয়া বোধ হয়?

আমরা রমাসুন্দরীকে অনেকদিন হইতে জানি । তিনি বিধবা; সন্তান সন্ততিও নাই। তীহার স্বামীর প্রভূত সম্পত্তি আছে, দুই চারিটি পাকা বাড়িও আছে। তাহার দেবর এখন সে সকল সম্পত্তির অধীশ্বর। দেবরটি কিন্তু রমাকে একমুঠা অন্ন এবং আশ্রয়দানেও কুষ্ঠিত। আমরা বলিলাম, “ইনি হয়ত দেবর-পত্রীর সহিত কৌদল করেন ।” এ কথার উত্তরে একজন বলিলেন, “রমা সব করিতে জানে, কেবল কৌদল জানে না। রমা বেশ জানে, কি করিয়া পরকে আপন করিতে হয়; কেবল আপনাকে পর করিতে জানে না।”

“এত গুণ সন্টেও দেবরের বাড়ি থাকিতে পান না কেন?”

“কপালের দোষ!”

আমরা একটি রাজবাড়ি দেখিতে গিয়াছিলাম। বাড়িখানি কবি-বর্ণিত অমরাবতীর ন্যায় মনোহর । বৈঠকখানা বিবিধ মূল্যবান সাজসজ্জায় ঝলমল করিতেছে; এদিকে সেদিকে ৫/৭ খানা রজত-আসন শূন্য হৃদয়ে রাজাকে আহ্বান করিতেছে! 

রাণীর ঘর কয়খানাতেও টেবিল, টিপাই, চেয়ার ইত্যাদি সাজসঙ্জা আছে। কিন্তু তাহার উপর ধুলার স্তর পড়িয়াছে। রাজা কোন কালে এসব কক্ষে পদার্পণ করেন বলিয়া বোধ হইল না।

রাণীকে দেখিয়া আমি হতাশ হইলাম । কারণ বৈঠকখানা দেখিয়া আমি রাণীর যেরপ মূর্তি কল্পনা করিয়াছিলাম, এ মূর্তি তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি পরমা সুন্দরী বালিকা- পরিধানে সামান্য লালপেড়ে বিলাতি ধুতি; মাথায় রুক্ষ কেশের জটা- অনুমান পনের দিন হইতে তৈলের সহিত চুলগুলির সাক্ষাৎ হয় নাই, মুখখানি এমনই করুণ ভাবে পূর্ণ যে রাণীকে মূর্তিমতী “বিষাদ” বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অনেকের মতে চক্ষু মনের দর্পণ স্বরূপ । রাণীর নয়ন দুটিতে কি কি হৃদয়বিদারক ভাব ছিল, তাহা আমি বর্ণনা করিতে অক্ষম ।

আমাদের একটি বর্ষীয়সী সঙ্গিনী বলিলেন, ““তুমি রাজার রাণী, তোমার এ বেশ কেন? এস আমি চুল বেঁধে দিই।” রাণী উত্তর দিলেন, “জানি না কি পাপে রাণী হয়েছি!” ঠিক কথা! অথচ লোকে এই রাণীর পদ কেমন বাঞ্ছনীয় বোধ করে!

“মহম্মাদীয় আইন” অনুসারে আমরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হই- “আমাদের বাড়ি”ও হয়। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়, - বাড়ির প্রকৃত কর্তা স্বামী, পুত্র, জামাতা, দেবর ইত্যাদি হন। তাহাদের অভাবে বড় আমলা বা নায়েবটি বাড়ির মালিক! গৃহকত্রীটি এ নায়েবের ত্রীড়াপুতুল মাত্র। নায়েব কন্রীকে যাহা বুঝায়, অবোধ নিরক্ষর কক্রী তাহাই বুঝেন ।

এরূপ আরও কত উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে । খদিজা প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী, তাহার স্বামী হাশেম দরিদ্র কিন্ত কুলীন বিদ্বান। হাশেম ছলে কৌশলে সমস্ত জমিজমা আত্মসাৎ করিয়া লইলেন; খদিজার হাতে এক পয়সা নাই। খদিজার পৈত্রিক বাড়িতে বসিয়াই হাশেম আর দুই তিনটা বিবাহ (?) করিয়া তাহাকে সতিনী জ্বালায় দগ্ধ করিতে লাগিলেন! এরূপ না করিলে আর ক্ষমতাশালী পুরুষের বাহাদুরি কি? ইহাতে যদি খদিজা আমার এই প্রবন্ধ পাঠ করিয়া ভ্রাতা ভগ্নীগণ হয়ত মনে করিবেন যে আমি কেবল ভ্রাতৃবৃন্দকে নরাকারে পিশাচরূপে অঙ্কিত করিবার জন্যই কলম ধরিয়াছি। তাহা নয়। আমি ত কোথাও ভ্রাতাদের প্রতি কটু শব্দ ব্যবহার করি নাই- কাহাকেও পাপিষ্ঠ, পিশাচ, নিষ্ঠুর বলিয়াছি কি? কেবল রমণীহদয়ের ক্ষত দেখাইয়াছি। এ যে কথায় বলে, “বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়”, এক্ষেত্রে তাহাই হইয়াছে- ভগ্মীর দুঃখ বর্ণনা করিতে ভ্রাতৃনিন্দা হইয়া পড়িয়াছে।

সুখের বিষয় আমাদের অনেক ভ্রাতা এরূপ আছেন, যাহারা স্ত্রীলোকদিগকে যথেষ্ট শান্তিতে গৃহসুখে রাখেন । কিন্তু দুঃখের সহিত আমরা ইহাও বলিতে বাধ্য যে অনেক ভ্রাতা আপন আপন বাটীতে অন্যায় স্বামীতের পরিচয় দিয়া থাকেন।

যখন আমাদের চালের উপর খড় থাকে না, দরিদ্রের জীর্ণ তম কুটিরের শেষ চালখানা ঝঞ্জানিলে উড়িয়া যায়, - টুপ-টাপ বৃষ্টিধারায় আমরা সমস্ত রাত্রি ভিজিতে থাকি, - চপলা-চমকে নয়নে ধাধা লাগে, - বজনাদে মেদিনী কাঁপে, এবং আমাদের বুক কীপে- প্রতি মুহূর্তে ভাবি, বুঝি বস্ুপাতে মারা যাই- তখনও আমরা অভিভাবকের বাটীতেই থাকি!

যখন আমরা রাজকন্যা, রাজবধূরূপে প্রাসাদে থাকি, তখনও প্রভু-গৃহে থাকি । আবার যখন এ প্রাসাদতুল্য ত্রিতল অট্টালিকা ভূমিকম্পে চূর্ণ হয়, - সোপান অতিক্রম করিয়া অবতরণ কালে আমাদের মাথা ভাঙ্গে, হাত পা ভাঙ্গে- রক্তাক্ত কলেবরে হতজ্ঞান প্রায় অবস্থায় গোশালায় গিয়া আশ্রয় লই, - তখনও অভিভাবকদের বাটীতে থাকি!!

অথবা গৃহস্থের বৌ-ঝি রূপে প্রকাণ্ড আটচালায় বাস করিলেও প্রভুর আলয়ে থাকি; আর যখন চৈত্র মাসে ঘোর অমানিশীথে প্রভুর বাটীতে দুষ্টরলোক কর্তৃক লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয় হয়, -সব জিনিসপত্রসহ ঘরগুলি দাউদাউ করিয়া জলিতে থাকে, - আমরা একবসনে প্রাণটি হাতে করিয়া কোনমতে দৌড়াইয়া গিয়া দূরস্থিত একটা কুলগাছতলে দীড়াইয়া কাপিতে থাকি,_ তখনও অভিভাবকের বাটীতে থাকি!!!

ইংরেজিতে (Home) বলিতে যাহা বুঝায়, ““গৃহ" শব্দ দ্বারা আমি তাহাই বুঝাইতে চাই । শারীরিক আরাম ও মানসিক শান্তিনিকেতন যাহা, তাহাই গৃহ। বিধবা হইলে স্বামীগৃহ একরূপ বাসের অযোগ্য হয়; হতভাগিনী তখন পিতা, ভ্রাতার শরণাপন্ন হয় । একটা হিন্দি প্রবাদ আছে:

“ঘর কি জলি বনমে গেয়ী-বনমে লাগি আগ

বন বেচারা কিয়া করে,- কররমমে লাগি আগ!”


অর্থাৎ ““গৃহে দগ্ধ হইয়া বনে গেলাম, বনে লাগিল আগুন; বন বেচারা কি করিবে, (আমার) কপালেই লাগিয়াছে আগুন |”

তাই বলি, গৃহ বলিতে আমাদেরই একটি পর্ণকুটীর নাই। প্রাণি-জগতে কোন জন্তই আমাদের মত নিরাশ্য়া নহে। সকলেরই গৃহ আছে- নাই কেবল আমাদের । (সংক্ষেপিত)


শব্দার্থ ও টীকা

বিরাম _. বিশ্রাম

নিকেতন _ বাড়ি।

শান্ত _ কাজ করে ক্লান্ত।

গৃহী _. গৃহে বসবাসকারী ।

উপাদেয় _ সুস্বাদু।

বাটা _ বাড়ি।

অন্তঃপুর _ ভেতর বাড়ি।

মেদিনী _ পৃথিবী ।

ত্রিতল _ তিন তলা বিশিষ্ট ।

অট্টালিকা _  দালান।

সোপান _ সিঁড়ি।

কলেবর _. দেহ, শরীর।

গোশালা _ গোয়ালঘর।

অমানিশীথ _ অন্ধকার রাত্রি।

লঙ্কাকাণ্ড - রাম-রাবণের যুদ্ধ । এখানে 'দুষ্টলোক কর্তৃক লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয়* বলতে

বোঝানো হয়েছে বাজে লোকের আক্রমণ ।

শরণাপন্ন _ শরণ অর্থ সাহায্য বা আশ্রয় । শরণ ও আপন্ন শব্দ দু'টি যুক্ত হয়ে শরণাপন্ন,

অর্থাৎ আশ্রয় বা সাহায্যপ্রার্থী।

পর্ণকুটার _ পাতার ঘর।

নিরাশ্রয়া _ আশ্রয়হীন


পাঠ-পরিচিতি - প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় সাধারণত বলা হয়ে থাকে, নারীর জন্য বরাদ্দ “ঘর", আর পুরুষের জন্য আছে “বাহির' ৷ অর্থাৎ পুরুষ সম্পৃক্ত থাকবে বাইরের জীবন ও জগতের সঙ্গে। অন্য দিকে, গার্স্থ্য ও পারিবারিক জীবনে সীমাবদ্ধ থাকবে নারী । এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সামজে পুরুষের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে; নারীকে করে তোলে ঘরের সামশ্বী। কিন্তু নারীর সত্যিই কোনো ঘর বা গৃহ আছে কিনা- এ নিয়েই তৈরি হতে পারে প্রশ্ন; রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এ প্রশ্নটিই তুলেছেন “গৃহ' প্রবন্ধে । ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতাসূত্রে তিনি দেখিয়েছেন পুরুষের আধিপত্য ও প্রতিপত্তির কাছে নারীর ঘরও বিপন্ন, ঘর বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই। নারীর অর্থ, সম্পদ, সম্পত্তি ও জীবনযাপন- প্রায় সব কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে পুরুষ । পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ ও সম্পত্তিও দখল করে নিয়েছে পুরুষ । প্রবন্ধটিতে বেশ কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে রোকেয়া দেখিয়েছেন পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও অভিভাবকতে নিজস্ব গৃহের আনন্দ ও অনুভূতি থেকে নারী প্রবলভাবে বঞ্চিত । পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান চিহ্িত করে দেখিয়েছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষ গৃহ বা ঘর প্রকৃতপক্ষে মানুষের শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির স্থান।


Post a Comment

0 Comments