Latest courses

বিলাসী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

 


লেখক-পরিচিতি - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জনুখহণ করেন। তার পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায়, জননী ভুবনমোহিনী দেবী । বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই উপন্যাসিকের ছেলেবেলা কাটে দারিদ্র্যের মধ্যে। চব্বিশ বছর বয়সে মনের ঝৌকে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন শরৎ্চন্দ্র। সংগীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতির সূত্রে ঘটনাচক্রে এক জমিদারের বন্ধু হয়েছিলেন তিনি; জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন বর্মা মুন্ুকে অর্থাৎ বর্তমান মিয়ানমারে । শরৎচন্দ্র তার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র সব মানুষের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তার বিভিন্ন উপন্যাসে । বিশেষ করে সমাজের নিচু তলার মানুষ তার সৃষ্ট চরিত্রে অপূর্ব মহিমা নিয়ে চিত্রিত হয়েছে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের শিল্পীমানসের মৌলবৈশিষ্ট্য মানবতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা । 

শরৎচন্দ্র প্রথম মুদ্রিত রচনা কুন্তলীন পুরস্কারপ্রাপ্ত “মন্দির” নামে একটি গল্প । তার বিখ্যাত  উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে : “দেবদাস", “পল্লি-সমাজ', “চরিত্রহীন', শ্রীকান্ত", “গৃহদাহ', “দেনাপাওনা" ইত্যাদি। এসব উপন্যাসে বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি অঙ্কনে তিনি অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন তার বহু উপন্যাস ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত ও চলচ্চত্রায়িত হয়েছে। তার কয়েকটি উপন্যাস বিদেশি ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে তাকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে।শরৎচন্দ্র ১৯৩৮ খিষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।


পাকা দুই ক্রোশ পথ হিয়া স্কুলে বিদ্যা অর্জন করিতে যাই। আমি একা নই-দশ-বারোজন। যাহাদেরই বাটা পল্লিগ্ামে, তাহাদেরই ছেলেদের শতকরা আশিজনকে এমনি করিয়া বিদ্যালাভ করিতে হয় । ইহাতে লাভের অঙ্কে শেষ পর্যন্ত একেবারে শূন্য না পড়িলেও, যাহা পড়ে, তাহাতে হিসাব করিবার পক্ষে এই কয়টা কথা চিন্তা করিয়া দেখিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যে ছেলেদের সকাল আটটার মধ্যে বাহির হইয়া যাতায়াতে চার ক্রোশ পথ ভাঙিতে হয়-চার ক্রোশ মানে আট মাইল নয়, ঢের বেশি-বর্ার দিনে মাথার ওপর মেঘের জল পায়ের নিচে এক হাটু কাদা এবং গ্রীষ্মের দিনে জলের বদলে কড়া সূর্য এবং কাদার বদলে ধুলার সাগর সীতার দিয়া স্কুল-ঘর করিতে হয়, সেই দুর্ভাগা বালকদের মা-সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি, তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি লুকাইবেন, ভাবিয়া পান না। 

তারপরে এই কৃতবিদ্য শিশুর দল বড় হইয়া একদিন গ্রামেই বসুন, আর ক্ষুধার জীলায় অন্যত্রই যান-তীদের চার ক্রোশ হাটা বিদ্যার তেজ আত্মপ্রকাশ করিবেই করিবে । কেহ কেহ বলেন শুনিয়াছি, আচ্ছা, যাদের ক্ষুধার জালা, তাদের কথা না হয় নাই ধরিলাম কিন্তু ধাদের সে জ্বালা নাই, তেমন সব জদ্রলোকই বা কী সুখে গ্রাম ছাড়িয়া পলায়ন করেন? তারা বাস করিতে থাকিলে তো পল্লির এত দুর্দশা হয় না। 

ম্যালেরিয়া কথাটা না হয় নাই পাড়িলাম। সে থাক, কিন্তু ওই চার ক্রোশ হাঁটার জালায় কত ভ্দ্রলোকেই যে ছেলে-পুলে লইয়া গ্রাম ছাড়িয়া শহরে পালান তাহার আর সংখ্যা নাই। তারপরে একদিন ছেলে-পুলের পড়াও শেষ হয় বটে, তখন কিন্তু শহরের সুখ-সুবিধা রুচি লইয়া আর তাদের গ্রামে ফিরিয়া আসা চলে না। কিন্তু থাক এ-সকল বাজে কথা । স্কুলে যাই-দুক্রোশের মধ্যে এমন আরও তো দুই তিনখানা গ্রাম পার হইতে হয়। কার বাগানে আম পাকিতে শুরু করিয়াছে, কোন বনে বইচি ফল অপর্যাপ্ত ফলিয়াছে, কার গাছে কাঠাল এই পাকিল বলিয়া, কার মর্তমান রম্তার কাদি কাটিয়া লইবার অপেক্ষা মাত্র, কার কানাচে ঝোপের মধ্যে আনারসের গায়ে রং ধরিয়াছে, কার পুকুরপাড়ের খেজুরমেতি কাটিয়া খাইলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা অল্প, এই সব খবর লইতেই সময় যায়, কিন্তু আসলে যা বিদ্যা-কামস্কাটকার রাজধানীর নাম কী এবং সাইবেরিয়ার খনির মধ্যে রূপা মেলে, না সোনা মেলে- এ সকল দরকারি তথ্য অবগত হইবার ফুরসতই মেলে না।


কাজেই এক্জামিনের সময় এডেন কী জিজ্ঞাসা করিলে বলি পারশিয়ার বন্দর, আর হুমায়ূনের বাপের নাম জানিতে চাহিলে লিখিয়া দিয়া আসি তোগলক খা এবং আজ চল্লিশের কোঠা পার হইয়াও দেখি, ও-সকল বিষয়ের ধারণা প্রায় একরকমই আছে-তারপরে প্রমোশনের দিন মুখ ভার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া কখনো বা দল বীধিয়া মতলব করি, মাস্টারকে ঠ্যাঙানো উচিত, কখনো বা ঠিক করি, অমন বিশ্রী স্কুল ছাড়িয়া দেওয়াই কর্তব্য । আমাদের গ্রামের একটি ছেলের সঙ্গে মাঝে মাঝেই স্কুলের পথে দেখা হইত । তাহার নাম ছিল মৃত্যুঞ্জয় । আমাদের চেয়ে সে বয়সে অনেক বড়। থার্ড ক্লাসে পড়িত। কবে সে যে প্রথম থার্ড ক্লাসে উঠিয়াছিল, এ খবর আমরা কেহই জানিতাম না- সম্ভবত তাহা প্রত্ুতান্তিকের গবেষণার বিষয়-আমরা কিন্তু তাহার ওই থার্ড ক্লাসটাই চিরদিন দেখিয়া আসিয়াছি।

তাহার ফোর্থ ক্লাসে পড়ার ইতিহাসও কখনো শুনি নাই, সেকেন্ড ক্লাসে উঠিবার খবরও কখনো পাই নাই। মৃত্যু্জয়ের বাপ-মা, ভাই-বোন কেহই ছিল না, ছিল শুধু গ্রামের এক প্রান্তে একটা প্রকাণ্ড আম-কীঠালের বাগান, আর তার মধ্যে একটা প্রকাণ্ড পোড়োবাড়ি, আর ছিল এক জ্ঞাতি খুড়া। খুড়ার কাজ ছিল ভাইপোর নানাবিধ দুর্নাম রটনা করা-সে গাজা খায়, সে গুলি খায়, এমনি আরও কত কি! তার আর একটা কাজ ছিল বলিয়া বেড়ানো, ওই বাগানের অর্ধেকটা তার নিজের অংশ, নালিশ করিয়া দখল করার অপেক্ষা মাত্র। অবশ্য দখল একদিন তিনি পাইয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে জেলা-আদালতে নালিশ করিয়া নয়-ওপরের আদালতের হুকুমে । কিন্ত সে কথা পরে হইবে।

মৃত্যুগ্য় নিজে রীধিয়া খাইত এবং আমের দিনে ওই আম-বাগানটা জমা দিয়াই তাহার সারা বসরের খাওয়া-পরা চলিত এবং ভালো করিয়াই চলিত। যেদিন দেখা হইয়াছে, সেইদিনই দেখিয়াছি ছেঁড়া-খোড়া মলিন বইগুলি বগলে করিয়া পথের এক ধার দিয়া নীরবে চলিয়াছে। তাহাকে কখনো কারও সহিত যাচিয়া আলাপ করিতে দেখি নাই-বরঞ্ উপযাচক হইয়া কথা কহিতাম আমরাই । তাহার প্রধান কারণ ছিল এই যে, দোকানের খাবার কিনিয়া খাওয়াইতে থ্ামের মধ্যে তাহার জোড়া ছিল না। আর শুধু ছেলেরাই নয়। কত ছেলের বাপ কতবার যে গোপনে ছেলেকে দিয়া তাহার কাছে স্কুলের মাহিনা হারাইয়া গেছে, বই চুরি গেছে ইত্যাদি বলিয়া টাকা আদায় করিয়া লইত, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু খণ স্বীকার করা তো দূরের কথা, ছেলে তাহার সহিত একটা কথা কহিয়াছে, এ কথাও কোনো বাপ ভদ্র সমাজে কবুল করিতে চাহিত না-খ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের ছিল এমনি সুনাম।

অনেক দিন মৃত্যুঞ্জয়ের দেখা নাই । একদিন শোনা গেল সে মর-মর। আর একদিন শোনা গেল, মালোপাড়ার এক বুড়া মালো তাহার চিকিৎসা করিয়া এবং তাহার মেয়ে বিলাসী সেবা করিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে যমের মুখ হইতে এ যাত্রা ফিরাইয়া আনিয়াছে। 

অনেক দিন তাহার মিষ্টান্নের সদ্যয় করিয়াছি- মনটা কেমন করিতে লাগিল, একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে লুকাইয়া তাহাকে দেখিতে গেলাম তাহার পোড়োবাড়িতে প্রাচীরের বালাই নাই। স্বচ্ছন্দে ভিতরে ঢুকিয়া দেখি, ঘরের দরজা খোলা, বেশ উজ্জ্বল একটি প্রদীপ জবলিতেছে, আর ঠিক সমুখেই তক্তপোষের ওপর পরিষ্কার ধবধবে বিছানায় মৃত্যু্রয় শুইয়া আছে, তাহার কষ্কালসার দেহের প্রতি চাহিলেই বুঝা যায়, বাস্তবিক যমরাজ চেষ্টার ত্রুটি কিছু করেন নাই, তবে যে শেষ পর্যন্ত সুবিধা করিয়া উঠিতে পারেন নাই, সে কেবল ওই মেয়েটির জোরে । সে শিয়রে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছিল, অকস্মাৎ মানুষ দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়া দীড়াইল। এই সেই বুড়া সাপুড়ের মেয়ে বিলাসী । তাহার বয়স আঠারো কি আটাশ ঠাহর করিতে পারিলাম না। কিন্তু মুখের প্রতি নাই। ঠিক যেন ফুলদানিতে জল দিয়া ভিজাইয়া রাখা বাসি ফুলের মতো । হাত দিয়া এতটুকু স্পর্শ করিলে, এতটুকু নাড়াচাড়া করিতে গেলেই ঝরিয়া পড়িবে ।

মৃত্যুঞ্জয় আমাকে চিনিতে পারিয়া বলিল, “কে, ন্যাড়া?”

বলিলাম, “|”


মেয়েটা ঘাড় হেট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মৃত্যুগুয় দুই-চারিটি কথায় যাহা কহিল, তাহার মর্ম এই যে, প্রায় দেড় মাস হইতে চলিল সে শয্যাগত। মধ্যে দশ-পনের দিন সে অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়াছিল, এই কয়েক দিন হইল সে লোক চিনিতে পারিতেছে এবং যদিচ এখনো সে বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারে না, কিন্তু আর ভয় নাই। ভয় নাই থাকুক। কিন্ত্ব ছেলেমানুষ হইলেও এটা বুঝিলাম, আজও যাহার শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিবার ক্ষমতা হয় নাই, সেই রোগীকে এই বনের মধ্যে একাকী যে মেয়েটি বাঁচাইয়া তুলিবার ভার লইয়াছেন, সে কত বড় গুরুভার। দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি তাহার কত সেবা, কত শুশ্রষা, কত ধৈর্য, কত রাতজাগা । সে কত বড় সাহসের কাজ! কিন্তু যে বস্তটি এই অসাধ্য-সাধন করিয়া তুলিয়াছিল তাহার পরিচয় যদিচ সেদিন পাই নাই, কিন্তু আর একদিন পাইয়াছিলাম।

ফিরিবার সময় মেয়েটি আর একটি প্রদীপ লইয়া আমার আগে আগে ভাঙা প্রাচীরের শেষ পর্যন্ত আসিল। এতক্ষণ পর্যন্ত সে একটি কথাও কহে নাই, এইবার আস্তে আস্তে বলিল, রাস্তা পর্যন্ত তোমায় রেখে আসব কি? বড় বড় আমগাছে সমস্ত বাগানটা যেন একটা জমাট অন্ধকারের মতো বোধ হইতেছিল, পথ দেখা তো দূরের কথা, নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যায় না। বলিলাম, “পৌঁছে দিতে হবে না, শুধু আলোটা দাও ।” সে প্রদীপটা আমার হাতে দিতেই তাহার উৎ্কপ্ঠিত মুখের চেহারাটা আমার চোখে পড়িল। আস্তে আস্তে সে বলিল, “একলা যেতে ভয় করবে না তো? একটু এগিয়ে দিয়ে আসব?”

মেয়ে মানুষ জিজ্ঞাসা করে, ভয় করবে না তো। সুতরাং মনে যাই থাক, প্রত্যুত্তরে শুধু একটা “না” বলিয়াই অগ্রসর হইয়া গেলাম। সে পুনরায় কহিল, “ঘন জঙ্গলের পথ, একটু দেখে পা ফেলে যেয়ো ।”

সর্বাঙ্গে কীটা দিয়া উঠিল, কিন্তু এতক্ষণে বুঝিলাম, উদ্বেটা তাহার কিসের জন্য এবং কেন সে আলো দেখাইয়া এই বনের পথ পার করিয়া দিতে চাহিতেছিল। হয়ত সে নিষেধ শুনিত না, সঙ্গেই যাইত, কিন্তু পীড়িত মৃত্যুগ্জয়কে একাকী ফেলিয়া যাইতেই বোধ করি তাহার শেষ পর্যন্ত মন সরিল না।

কুড়ি-পচিশ বিঘার বাগান । সুতরাং পথটা কম নয় । এই দারুণ অন্ধকারের মধ্যে প্রত্যেক পদক্ষেপই বোধ করি ভয়ে ভয়ে করিতে হইত, কিন্তু পরক্ষণই মেয়েটির কথাতেই সমস্ত মন এমনি আচ্ছন্ন হইয়া রহিল যে, ভয় পাইবার আর সময় পাইলাম না। কেবল মনে হইতে লাগিল, একটা মৃতকল্প রোগী লইয়া থাকা কত কঠিন। মৃত্যুঞ্জয় তো যে-কোনো মুহূর্তেই মরিতে পারিত, তখন সমস্ত রাত্রি এই বনের মধ্যে মেয়েটি একাকী কী করিত। কেমন করিয়া তাহার সে রাতটা কাটিত।

এই প্রসঙ্গে অনেকদিন পরের একটা কথা আমার মনে পড়ে । এক আত্তরীয়ের মৃত্যুকালে আমি উপস্থিত ছিলাম । অন্ধকার রাত্রি-বাটীতে ছেলে-পুলে, চাকর-বাকর নাই, ঘরের মধ্যে শুধু তার সদ্যবিধবা স্ত্রী আর আমি । তার স্ত্রী তো শোকের আবেগে দাপাদাপি করিয়া এমন কাণ্ড করিয়া তুলিলেন যে, ভয় হইল তাহারও প্রাণটা বুঝি বাহির হইয়া যায় বা! কীদিয়া কীদিয়া বারবার আমাকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় যখন সহমরণে যাইতে চাহিতেছেন, তখন সরকারের কী? তার যে আর তিলার্ধ বাচিতে সাধ নাই, এ কি তাহারা বুঝিবে না?

তাহাদের ঘরে কি স্ত্রী নাই? তাহারা কি পাষাণ? আর এই রাত্রেই গ্রামের পাচজন যদি নদীর তীরের কোনো একটা জঙ্গলের মধ্যে তার সহমরণের যোগাড় করিয়া দেয় তো পুলিশের লোক জানিবে কী করিয়া? এমনি কত কি। কিন্তু আমার তো আর বসিয়া বসিয়া তার কান্না শুনিলেই চলে না। পাড়ায় খবর দেওয়া চাই-অনেক জিনিস যোগাড় করা চাই। কিন্তু আমার বাহিরে যাইবার প্রস্তাব শুনিয়াই তিনি প্রকৃতিস্থ হইয়া উঠিলেন। চোখ মুছিয়া বলিলেন, “ভাই, যা হবার সে তো হইয়াছে, আর বাইরে গিয়া কী হইবে? রাতটা কাটুক না।” 

বলিলাম, “অনেক কাজ, না গেলেই যে নয়”

তিনি বলিলেন, “হোক কাজ, তুমি বসো।”


বলিলাম, “বসলে চলবে না, একবার খবর দিতেই হইবে”, বলিয়া পা বাড়াইবামাত্রেই তিনি চিৎকার করিয়া উঠিলেন, “ওরে বাপরে! আমি একলা থাকতে পারব না।” কাজেই আবার বসিয়া পড়িতে হইল । কারণ, তখন বুঝিলাম, যে স্বামী জ্যান্ত থাকতে তিনি নির্ভয়ে পচিশ বৎসর একাকী ঘর করিয়াছেন, তাঁর মৃত্যুটা যদি-বা সহে তার মৃতদেহটা এই অন্ধকার রাত্রে পাঁচ মিনিটের জন্যও সহিবে না। বুক যদি কিছুতে ফাটে তো সে এই মৃত স্বামীর কাছে একলা থাকিলে । 

কিন্তু দুঃখটা তাহার তুচ্ছ করিয়া দেখানও আমার উদ্দেশ্য নহে। কিংবা তাহা খাঁটি নয় এ কথা বলাও আমার অভিপ্রায় নহে। কিংবা একজনের ব্যবহারেই তাহার চূড়ান্ত মীমাংসা হইয়া গেল তাহাও নহে। কিন্তু এমন আরও অনেক ঘটনা জানি, যাহার উল্লেখ না করিয়াও আমি এই কথা বলিতে চাই যে, শুধু কর্তব্যজ্ঞানের জোরে অথবা বহুকাল ধরিয়া একসঙ্গে ঘর করার অধিকারেই এই ভয়টাকে কোনো মেয়েমানুষই অতিক্রম করিতে পারে না। ইহা আর একটি শক্তি, যাহা বহু স্বামী-স্ত্রী একশ বৎসর একত্রে ঘর করার পরেও হয়ত তাহার কোনো সন্ধান পায় না।


কিন্ত সহসা সে শক্তির পরিচয় যখন কোনো নরনারীর কাছে পাওয়া যায়, তখন সমাজের আদালতে আসামি করিয়া তাহাদের দণ্ড দেওয়ার আবশ্যক যদি হয় তো হোক, কিন্তু মানুষের যে বস্তটি সামাজিক নয়, সে নিজে যে ইহাদের দুঃখে গোপন অশ্রু বিসর্জন না করিয়া কোনো মতেই থাকিতে পারে না। প্রায় মাস দুই মৃত্যুপ্জয়ের খবর লই নাই। যাহারা পল্লিঘাম দেখেন নাই, কিংবা ওই রেলগাড়ির জানালায় মুখ বাড়াইয়া দেখিয়াছেন, তাহারা হয়ত সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিবেন, এ কেমন কথা? এ কি কখনো সম্ভব হইতে পারে যে, অত বড় অসুখটা চোখে দেখিয়া আসিয়াও মাস-দুই আর তার খবরই নাই । তাহাদের অবগতির জন্য বলা আবশ্যক যে, এ শুধু সম্ভব নয়, এ-ই হইয়া থাকে । একজনের বিপদে পাড়াসুদ্ধ ঝাক বীধিয়া উপুড় হইয়া পড়ে, এই যে, একটা জনশ্রুতি আছে, জানি না তাহা সত্যযুগের পল্লিামে ছিল কি না, কিন্তু একালে তো কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারি না। তবে তাহার মরার খবর যখন পাওয়া যায় নাই, তখন সে যে বীচিয়া আছে এ ঠিক। এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন কানে গেল, মৃত্যুগ্জয়ের সেই বাগানের অংশীদার খুড়া তোলপাড় করিয়া বেড়াইতেছেন যে, গেল গেল, গ্রামটা এবার রসাতলে গেল । নালতের মিত্তির বলিয়া সমাজে আর তার মুখ বাহির করিবার যো রহিল না-অকালকুম্মাগুটা একটা সাপুড়ের মেয়ে নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে। আর শুধু নিকা নয়, তাও না হয় চুলায় যাক, তাহার হাতে ভাত পর্যন্ত খাইতেছে। গ্রামে যদি ইহার শাসন না থাকে তো বনে গিয়া বাস করিলেই তো হয়। কোড়োলা, হরিপুরের সমাজ একথা শুনিলে যে - ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন ছেলে বুড়ো সকলের মুখেই ওই এক কথা-আ্যা এ হইল কী? কলি কি সত্যই উল্টাইতে বসিল।

খুড়া বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, এ যে ঘটিবে তিনি অনেক আগেই জানিতেন। তিনি শুধু তামাশা দেখিতেছিলেন, কোথাকার জল কোথায় গিয়া পড়ে । নইলে পর নয়, প্রতিবেশী নয়, আপনার ভাইপো । তিনি কি বাড়ি লইয়া যাইতে পারিতেন না? তাহার কি ডাক্তার-বৈদ্য দেখাইবার ক্ষমতা ছিল না? তবে কেন যে করেন নাই, এখন দেখুন সবাই । কিন্তু আর তো চুপ করিয়া থাকা যায় না। এ যে মিত্তির বংশের নাম ডূবিয়া যায় । গ্রামের যে মুখ পোড়ে। তখন আমরা গ্রামের লোক মিলিয়া যে কাজটা করিলাম, তাহা মনে করিলে আমি আজও লজ্জায় মরিয়া যাই। খুড়া চলিলেন নালতের মিত্তির বংশের অভিভাবক হইয়া, আর আমরা দশ-বারোজন সঙ্গে চলিলাম গ্রামের বদন দগ্ধ না হয় এইজন্য।

মৃত্যু্জয়ের পোড়োবাড়িতে গিয়া যখন উপস্থিত হইলাম তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে। মেয়েটি ভাঙা বারান্দায় একধারে রুটি গড়িতেছে। অকস্মাৎ লাঠিসোটা হাতে এতগুলি লোককে উঠানের ওপর দেখিয়া ভয়ে নীলবর্ণ হইয়া গেল। খুড়া ঘরের মধ্যে উকি মারিয়া দেখলেন, মৃত্যুপ্রয় শুইয়া আছে। চট করিয়া শিকলটা টানিয়া দিয়া সেই ভয়ে মৃতপ্রায় মেয়েটিকে সম্ভাষণ শুরু করিলেন । বলা বাহুল্য, জগতের কোনো খুড়া কোনো কালে বোধ করি ভাইপোর-্ত্রীকে ওরূপ সম্ভাষণ করে নাই । সে এমনি যে, মেয়েটি হীন সাপুড়ের মেয়ে হইয়াও তাহা সহিতে পারিল না, চোখ তুলিয়া বলিল, বাবা আমারে বাবুর সাথে নিকা দিয়েছে জানো?

খুড়া বলিলেন তবে রে! ইত্যাদি ইত্যাদি এবং সঙ্গে সঙ্গেই দশ-বারোজন বীরদর্পে হুংকার দিয়া তাহার ঘাড়ে পড়িল। কেহ ধরিল চুলের মুঠি, কেহ ধরিল কান, কেহ ধরিল হাত-দুটো এবং যাহাদের সে সুযোগ ঘটিল না তাহারাও নিশ্টেষ্ট হইয়া রহিল না। কারণ, সংগ্রামস্থলে আমরা কাপুরুষের ন্যায় চুপ করিয়া থাকিতে পারি, আমাদের বিরুদ্ধে এত বড় দুর্নাম রটনা করিতে বোধ করি নারায়ণের কর্তৃপক্ষেরও চক্ষুলজ্জা হইবে ।

এইখানে একটা অবান্তর কথা বলিয়া রাখি। শুনিয়াছি নাকি বিলাত প্রভৃতি শ্রেচ্ছদেশে পুরুষদের মধ্যে একটা ংস্কার আছে, স্ত্রীলোক দুর্বল এবং নিরুপায় বলিয়া তাহার গায়ে হাত তুলিতে নাই। এ আবার একটা কী কথা! সনাতন হিন্দু এ কুসংস্কার মানে না । আমরা বলি যাহারই গায়ে জোর নাই, তাহারই গায়ে হাত তুলিতে পারা যায়। তা সে নরনারী যাই হোক না কেন।

মেয়েটি প্রথমেই সেই যা একবার আর্তনাদ করিয়া উঠিয়াছিল, তারপর একেবারে চুপ করিয়া গেল। কিন্তু আমরা লাগিল, “বাবুরা, আমাকে একটিবার ছেড়ে দাও আমি রুটিগুলো ঘরে দিয়ে আসি । বাইরে শিয়াল কুকুরে খেয়ে যাবে-রোগা মানুষ সমস্ত রাত খেতে পাবে না।” মৃত্যুঞ্জয় রুদ্ধ ঘরের মধ্যে পাগলের মতো মাথা কুটিতে লাগিল, দ্বারে পদাঘাত করিতে লাগিল এবং শ্াব্য-অশ্রাব্য বহুবিধ ভাষা প্রয়োগ করিতে লাগিল। কিন্তু আমরা তাহাতে তিলার্ধ বিচলিত হইলাম না। চলিলাম বলিতেছি, কেননা, আমিও বরাবর সঙ্গে ছিলাম, কিন্তু কোথায় আমার মধ্যে একটুখানি দুর্বলতা ছিল, আমি তার গায়ে হাত দিতে পারি নাই । বরঞ্চ কেমন যেন কান্না পাইতে লাগিল । সে যে অত্যন্ত অন্যায় করিয়াছে এবং তাহাকে গ্রামের বাহির করাই উচিত বটে, কিন্তু এটাই যে আমরা ভালো কাজ করিতেছি সেও কিছুতেই মনে করিতে পারিলাম না। কিন্তু আমার কথা থাক। 

আপনারা মনে করিবেন না, পল্লিগ্ামে উদারতার একান্ত অভাব । মোটেই না। বরঞ্চ বড়লোক হইলে আমরা এমন সব ওদার্য প্রকাশ করি যে, শুনিলে আপনারা অবাক হইয়া যাইবেন। এই মৃত্যুগ্য়টাই যদি না তাহার হাতে ভাত খাইয়া অমার্জনীয় অপরাধ করিত তাহা হইলে তো আমাদের এত রাগ হইত না। আর কায়েতের ছেলের সঙ্গে সাপুড়ের মেয়ের নিকা-এ তো একটা হাসিয়া উড়াইবার কথা কিন্ত কাল করিল যে ওই ভাত খাইয়া। হোক না সে আড়াই মাসের রোগী, হোক না সে শয্যাশায়ী কিন্তু তাই বলিয়া ভাত! লুচি নয়, সন্দেশ নয়, পাঁঠার মাংস নয় । ভাত খাওয়া যে অন্ন-পাপ। সে তো আর সত্য সত্যই মাপ করা যায় না। তা নইলে পল্লিগায়ের লোক সংকীর্ণচিত্ত নয়। চার ক্রোশ হাটা বিদ্যা যেসব ছেলের পেটে তারাই তো একদিন বড় হইয়া সমাজের মাথা হয় । 

দেবী বীণাপাণির বরে সংকীর্ণতা তাহাদের মধ্যে আসিবে কী করিয়া! এই তো ইহারই কিছুদিন পরে, প্রাতঃস্মরণীয় স্বগাঁয় মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বিধবা পুত্রবধূ মনের বৈরাগ্যে বছর দুই কাশীবাস করিয়া যখন ফিরিয়া আসিলেন, তখন নিন্দুকেরা কানাকানি করিতে লাগিল যে, অর্ধেক সম্পত্তি ওই বিধবার এবং পাছে তাহা বেহাত হয় এই ভয়েই ছোটবাবু অনেক চেষ্টা, অনেক পরিশ্রমের পর বৌঠানকে যেখান হইতে ফিরাইয়া আনিয়াছেন, সেটা কাশীই বটে। যাই হোক, ছোটবাবু তাহার স্বাভাবিক উঁদার্ষে গ্রামের প্রত্যেক সদবান্গণের হাতে যখন একটা করিয়া কাসার গেলাস দিয়া বিদায় করিলেন, তখন ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল। এমনকি, পথে আসিতে অনেকেই দশের এবং দেশের কল্যাণের নিমিত্ত কামনা করিতে লাগিলেন, এমন সব যারা বড়লোক তাদের বাড়িতে বাড়িতে, মাসে মাসে এমন সদানুষ্ঠানের আয়োজন হয় না কেন?


কিন্তু যাক। মহত্ের কাহিনি আমাদের অনেক আছে। যুগে যুগে সঞ্চিত হইয়া প্রায় প্রত্যেক পল্লিবাসীর দ্বারেই স্তুপাকার হইয়া উঠিয়াছে। এই দক্ষিণ বন্গের অনেক পল্লিতে অনেকদিন ঘুরিয়া গৌরব করিবার মত অনেক বড় বড় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়াছি। চরিত্রেই বল, ধর্মেই বল, সমাজেই বল, আর বিদ্যাতেই বল, শিক্ষা একেবারেই পুরা হইয়া আছে; এখন শুধু ইংরাজকে কষিয়া গালিগালাজ করিতে পারিলে দেশটা উদ্ধার হইয়া যায়। বৎসরখানেক গত হইয়াছে। মশার কামড় আর সহ্য করিতে না পারিয়া সবেমাত্র সন্যাসীগিরিতে ইস্তফা দিয়া ঘরে ফিরিয়াছি। একদিন দুপুরবেলা ক্রোশ দুই দূরের মালোপাড়ার ভিতর দিয়া চলিয়াছি, হঠাৎ দেখি, একটা কুটিরের দ্বারে বসিয়া মৃত্যুঞ্জয় তাহার মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, বড় বড় দাড়ি-চুল, গলায় রুদ্রাক্ষ ও পুঁতির মালা-কে বলিবে এ আমাদের সেই মৃত্যু্জয়। কায়স্থের ছেলে একটা বছরের মধ্যেই জাত দিয়া একেবারে পুরাদস্তর সাপুড়ে হইয়া গিয়াছে। মানুষ কত শীঘ্র যে তাহার চৌদ্দ পুরুষের জাতটা বিসর্জন দিয়া আর একটা জাত হইয়া উঠিতে পারে, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। ব্রাহ্মণের ছেলে মেথরানি বিবাহ করিয়া মেথর হইয়া গেছে এবং তাহাদের ব্যবসা অবলম্বন করিয়াছে, এ বোধ করি আপনারা সবাই শুনিয়াছেন। আমি সদব্াহ্গণের ছেলেকে এন্ট্রা্স পাস করার পরেও ডোমের মেয়ে বিবাহ করিয়া ডোম হইতে দেখিয়াছি। এখন সে ধুচুনি কুলো বুনিয়া বিক্রয় করে, শুয়ার চরায়। ভালো কায়স্থ-সন্তানকে কসাইয়ের মেয়ে বিবাহ করিয়া কসাই হইয়া যাইতেও দেখিয়াছি। আজ সে স্বহস্তে গরু কাটিয়া বিক্রয় করে-তাহাকে দেখিয়া কাহার সাধ্য বলে, কোনো কালে সে কসাই ভিন্ন আর কিছু ছিল। কিন্তু সকলেরই ওই একই হেতু । আমার তাই তো মনে হয়, এমন করিয়া এত সহজে পুরুষকে যাহারা টানিয়া নামাইতে পারে তাহারা কি এমনিই অবলীলাক্রমে তাহাদের ঠেলিয়া উপরে তুলিতে পারে না? যে পল্লিথামের পুরুষদের সুখ্যাতিতে আজ পঞ্চমুখ হইয়া উঠিয়াছি, গৌরবটা কি একা শুধু তাহাদেরই? শুধু নিজেদের জোরেই এত দ্রুত নিচের দিকে নামিয়া চলিয়াছে। অন্দরের দিক হইতে কি এতটুকু উৎসাহ, এতটুকু সাহায্য আসে না?

কিন্তু যাক। ঝৌকের মাথায়, হয়ত বা অনধিকারচর্চা করিয়া বসিব। কিন্তু আমার মুশকিল হইয়াছে যে, আমি কোনোমতেই ভুলিতে পারি না, দেশের নব্বই জন নরনারীই ওই পল্লিঘামেরই মানুষ এবং সেই জন্য কিছু একটা আমাদের করা চাই-ই। যাক। বলিতেছিলাম যে, দেখিয়া কে বলিবে এ সেই মৃত্যুরয়। কিন্তু আমাকে সে খাতির করিয়া বসাইল। বিলাসী পুকুরে জল আনিতে গিয়াছিল, আমাকে দেখিয়া সেও ভারি খুশি হইয়া বার বার বলিতে লাগিল, “তুমি না আগলালে সে রান্তিরে আমাকে তারা মেরেই ফেলত । আমার জন্য না জানি কত মার তুমি খেয়েছিলে।” কথায় কথায় শুনিলাম, পরদিনই তাহারা এখানে উঠিয়া আসিয়া ক্রমশ ঘর বীধিয়া বাস করিতেছে এবং সুখে আছে। সুখে যে আছে একথা আমাকে বলার প্রয়োজন ছিল না, শুধু তাহাদের মুখের পানে চাহিয়াই আমি তাহা বুঝিয়াছিলাম।

তাই শুনিলাম, আজ কোথায় নাকি তাহাদের সাপ ধরার বায়না আছে এবং তাহারা প্রস্তুত হইয়াছে, আমিও অমনি সঙ্গে যাইবার জন্য লাফাইয়া উঠিলাম। ছেলেবেলা হইতেই দুটা জিনিসের ওপর আমার প্রবল শখ ছিল। এক ছিল গোখরা সাপ ধরিয়া পোষা, আর ছিল মন্ত্র-সিদ্ধ হওয়া । সিদ্ধা হওয়ার উপায় তখনও খুঁজিয়া বাহির করিতে পারি নাই। কিন্তু মৃত্যুপ্রয়কে ওস্তাদ লাভ করিবার আশায় আনন্দে উৎফুল্র হইয়া উঠিলাম। সে তাহার নামজাদা শ্বশুরের শিষ্য, সুতরাং মস্ত লোক । আমার ভাগ্য যে অকন্মাৎ এমন প্রসন্ন হইয়া উঠিবে তাহা কে ভাবিতে পারিত?

কিন্তু শক্ত কাজ এবং ভয়ের কারণ আছে বলিয়া প্রথমে তাহারা উভয়েই আপত্তি করিল, কিন্তু আমি এমনি নাছোড়বান্দা হইয়া উঠিলাম যে, মাস খানেকের মধ্যে আমাকে সাগরেদ করিতে মৃত্যু্তয় পথ পাইল না । সাপ ধরার মন্ত্র এবং হিসাব শিখাইয়া দিল এবং কবজিতে ওষুধ সমেত মাদুলি বাধিয়া দিয়া দস্তরমত সাপুড়ে বানাইয়া তুলিল। মন্ত্রটা কি জানেন? তার শেষটা আমার মনে আছে-

-ওরে কেউটে তুই মনসার বাহন-

মনসা দেবী আমার মা_

ওলটপালট পাতাল-ফৌড়-

টোড়ার বিষ তুই নে, তোর বিষ টোড়ারে দে_

_দুধরাজ, মণিরাজ।

কার আজ্ঞা-বিষহরির আজ্ঞা ।

ইহার মানে যে কী তাহা আমি জানি না। কারণ, যিনি এই মন্ত্রেরও দ্রষ্টা খষি ছিলেন-নিশ্চয় কেহ না কেহ ছিলেন-তীর সাক্ষাৎ কখনও পাই নাই। অবশেষে একদিন এই মন্ত্রের সত্য মিথ্যার চরম মীমাংসা হইয়া গেল বটে, কিন্তু যতদিন না হইল ততদিন সাপ ধরার জন্য চতুর্দিকে প্রসিদ্ধ হইয়া গেলাম । সবাই বলাবলি করিতে লাগিল, হ্যা, ন্যাড়া একজন গুণী লোক বটে। সন্ন্যাসী অবস্থায় কামাখ্যায় গিয়া সিদ্ধ হইয়া আসিয়াছে। এতটুকু বয়সের মধ্যে এত বড় ওস্তাদ হইয়া অহংকারে আমার মাটিতে পা পড়ে না, এমনি যো হইল। বিশ্বাস করিল না শুধু দুই জন। আমার গুরু যে, সে তো ভালো মন্দ কোনো কথাই বলিত না। কিন্ত বিলাসী মাঝে মাঝে মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিত, ঠাকুর, এসব ভয়ংকর জানোয়ার, একটু সাবধানে নাড়াচাড়া করো । বন্তত বিষদীত ভাঙা, সাপের মুখ হইতে বিষ বাহির করা প্রভৃতি কাজগুলো এমনি অবহেলার সহিত করিতে শুরু করিয়াছিলাম যে, সেসব মনে পড়িলে আমার আজও গা কাপে।

আসলে কথা হইতেছে এই যে, সাপ ধরাও কঠিন নয় এবং ধরা সাপ দুই চারদিন হাঁড়িতে পুরিয়া রাখার পরে তাহার বিষর্দীত ভাঙাই হোক আর নাই হোক, কিছুতেই কামড়াইতে চাহে না। চক্র তুলিয়া কামড়াইবার ভান করে, ভয় দেখায়, কিন্তু কামড়ায় না। মাঝে মাঝে আমাদের গুরুশিষ্যের সহিত বিলাসী তর্ক করিত। সাপুড়েদের সবচেয়ে লাভের ব্যবসা শিকড় বিক্রি করা, যা দেখাইবামাত্র সাপ পালাইতে পথ পায় না। কিন্তু তার পূর্বে সামান্য একটু কাজ করিতে হইত । যে সাপটা শিকড় দেখিয়া পালাইবে, তাহার মুখে একটা লোহার শিক পুড়াইয়া বার কয়েক ছ্যাকা দিতে হয়। তারপর তাহাকে শিকড়ই দেখান হোক বা একটা কাঠিই দেখান হোক, সে কোথায় পালাইবে তা ভাবিয়া পায় না। এই কাজটার বিরুদ্ধে বিলাসী ভয়ানক আপত্তি করিয়া মৃত্যুপ্রয়কে বলিত, “দেখ, এমন করে মানুষ ঠকায়ো না।” মৃত্যুঞ্জয় কহিত, “সবাই করে-এতে দোষ কী?”

বিলাসী বলিত, “করুক গে সবাই । আমাদের তো খাবার ভাবনা নেই, আমরা কেন মিছামিছি লোক ঠকাতে যাই।” আর একটা জিনিস আমি বারবার লক্ষ করিয়াছি। সাপ ধরার বায়না আসিলেই বিলাসী নানাপ্রকারে বাধা দিবার চেষ্টা করিত-আজ শনিবার, আজ মঙ্গলবার, এমনি কত কি। মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিত না থাকিলে সে তো একবারেই ভাগাইয়া দিত, কিন্তু উপস্থিত থাকিলে মৃত্যুঞ্জয় নগদ টাকার লোভ সামলাইতে পারিত না। আর আমার তো একরকম নেশার মত হইয়া দীড়াইয়াছিল। নানাপ্রকারে তাহাকে উত্তেজিত করিতে চেষ্টার ক্রুটি করিতাম না। বন্তত ইহার মধ্যে মজা ছাড়া ভয় যে কোথায় ছিল, এ আমাদের মনেই স্থান পাইত না। কিন্তু এই পাপের দণ্ড আমাকে একদিন ভালো করিয়াই দিতে হইল। 

সেদিন ক্রোশ-দেড়েক দূরে এক গোয়ালার বাড়িতে সাপ ধরিতে গিয়াছি। বিলাসী বরাবরই সঙ্গে যাইত, আজও সঙ্গে ছিল। মেটে ঘরের মেঝে খানিকটা খুঁড়িতেই একটা গর্তের চিহ্ন পাওয়া গেল। আমরা কেহই লক্ষ করি নাই, কিন্তু বিলাসী সাপুড়ের মেয়ে-সে হেট হইয়া কয়েক টুকরা কাগজ তুলিয়া লইয়া আমাকে বলিল, “ঠাকুর, একটু সাবধানে খুঁড়ো। সাপ একটা নয় একজোড়া তো আছে বটেই হয়ত বা বেশি থাকিতে পারে ।”

মৃত্যুঞ্জয় বলিল, “এরা যে বলে একটাই এসে ঢুকেছে। একটাই দেখতে পাওয়া গেছে।” 

বিলাসী কাগজ দেখাইয়া কহিল, “দেখছ না বাসা করেছিল?”

মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “কাগজ তো ইদুরেও আনতে পারে ।”

বিলাসী কহিল, “দু-ই হতে পারে। কিন্তু দুটো আছে আমি বলছি।”

বাস্তবিক বিলাসীর কথাই ফলিল এবং মর্মান্তিকভাবেই সেদিন ফলিল। মিনিট-দশেকের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড খরিশ গোখরো ধরিয়া ফেলিয়া মৃত্যুপ্র় আমার হাতে দিল। কিন্তু সেটাকে ঝাঁপির মধ্যে পুরিয়া ফিরিতে না ফিরিতেই মৃত্যপ্য় করিয়া নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাহিরে আসিয়া দীড়াইল। তাহার হাতের উলটা পিঠ দিয়ে ঝারঝার করিয়া রক্ত পড়িতেছিল প্রথমটা যেন সবাই হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম । কারণ সাপ ধরিতে গেলে সে পালাইবার জন্য ব্যাকুল না হইয়া বরঞ্চ গর্ত হইতে একহাত মুখ বাহির করিয়া দংশন করে, এমন অভাবনীয় ব্যাপার জীবনে এই একটিবার দেখিয়াছি।

পরক্ষণেই বিলাসী চিৎকার করিয়া ছুটিয়া গিয়া আঁচল দিয়া তাহার হাতটা বাঁধিয়া ফেলিল এবং যত রকমের শিকড়-বাকড় সে সঙ্গে আনিয়াছিল সমস্তই তাহাকে চিবাইতে দিল । মৃত্যুঞ্জয়ের নিজের মাদুলি তো ছিলই, তাহার উপরে আমার মাদুলিটাও খুলিয়া তাহার হাতে বাঁধিয়া দিলাম । আশা, বিষ ইহার উধ্র্বে আর উঠিবে না, বরং সেই “বিষহরির আজ্ঞা" মন্ত্রটা সতেজে বারংবার আবৃত্তি করিতে লাগিলাম। চতুর্দিকে ভিড় জমিয়া গেল এবং এ অঞ্চলের মধ্যে যেখানে যত গুণী ব্যক্তি আছেন সকলকে খবর দিবার জন্য দিকে দিকে লোক ছুটিল। 'বিলাসীর বাপকে সংবাদ দিবার জন্য লোক গেল।

আমার মন্ত্র পড়ার আর বিরাম নাই, কিন্তু ঠিক সুবিধা হইতেছে বলিয়া মনে হইল না । তথাপি আবৃত্তি সমভাবেই চলিতে লাগিল । কিন্তু মিনিট পনের কুড়ি পরেই যখন মৃত্যুঞ্জয় একবার বমি করিয়া দিল, তখন বিলাসী মাটির ওপর একবারে আছাড় খাইয়া পড়িল । আমিও বুঝিলাম, বিষহরির দোহাই বুঝি-বা আর খাটে না। নিকটবর্তী আরও দুই-চারিজন ওস্তাদ আসিয়া পড়িলেন এবং আমরা কখনও-বা একসঙ্গে কখনও আলাদা তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর দোহাই পাড়িতে লাগিলাম। কিন্তু বিষ দোহাই মানিল না, রোগীর অবস্থা ক্রমেই মন্দ হইতে লাগিল । যখন দেখা গেল ভালো কথায় হইবে না, তখন তিন-চারজন ওঝা মিলিয়া বিষকে এমনি অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ করিতে লাগিল যে, বিষের কান থাকিলে সে মৃত্যুঞ্জয় তো মৃত্যুপ্যয়, সেদিন দেশ ছাড়িয়া পলাইত। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। আরও আধ ঘণ্টা ধ্বস্তাধ্স্তির পরে রোগী তাহার বাপ মায়ের দেওয়া মৃত্যুঞ্জয় নাম, তাহার শ্বশুরের দেওয়া মন্ত্রৌষধি সমস্ত মিথ্যা প্রতিপন্ন করিয়া ইহলোকের লীলা সাঙ্গ করিল।

বিলাসী তাহার স্বামীর মাথাটা কোলে করিয়া বসিয়াছিল সে যেন একেবারে পাথর হইয়া গেল।

যাক, তাহার দুঃখের কাহিনিটি আর বাড়াইব না। কেবল এইটুকু বলিয়া শেষ করিব যে, সে সাত দিনের বেশি বাচিয়া থাকাটা সহিতে পারিল না। আমাকে শুধু একদিন বলিয়াছিল, ঠাকুর আমার মাথার দিব্যি রইল, এসব তুমি আর কখনও করো না।

আমার মাদুলি-কবচ তো মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে কবরে গিয়াছিল, ছিল শুধু বিষহরির আজ্ঞা। কিন্তু সে আজ্ঞা যে ম্যাজিস্ট্রেটের আজ্ঞা নহে এবং সাপের বিষ যে বাঙালির বিষ নয়, তাহা আমিও বুঝিয়াছিলাম । একদিন গিয়া শুনিলাম, ঘরে তো আর বিষের অভাব ছিল না, বিলাসী আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছে এবং শাস্ত্রমতে সে নিশ্চয় নরকে গিয়াছে। কিন্তু যেখানেই যাক, আমার নিজের যখন যাইবার সময় আসিবে, তখন ওইরূপ কোনো একটা নরকে যাওয়ার প্রস্তাবে পিছাইয়া দীড়াইব না, এইমাত্র বলিতে পারি ।

খুড়া মশাই ষোল আনা বাগান দখল করিয়া অত্যন্ত বিজ্ঞের মতো চারিদিকে বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, ওর যদি না অপঘাত-মৃত্যু হবে, তো হবে কার? পুরুষমানুষ অমন একটা ছেড়ে দশটা করুক না, তাতে তো তেমন আসে যায় না-না হয় একটু নিন্দাই হতো । কিন্তু হাতে ভাত খেয়ে মরতে গেলি কেন? নিজে মরলো, আমার পর্যন্ত মাথা হেট করে গেল । না পেলে এক ফৌটা আগুন, না পেলে একটা পিণ্ডি, না হলো একটা ভূজ্যি উচ্ছুপ্য ৷ গ্রামের লোক একবাক্যে বলিতে লাগিল, তাহাতে আর সন্দেহ কী! অন্নপাপ। বাপ রে! এর কি আর প্রায়শ্চিত্ত আছে।

'বিলাসীর আত্মহত্যার ব্যাপারটা অনেকের কাছে পরিহাসের বিষয় হইল । আমি প্রায় ভাবি, এ অপরাধ হয়ত ইহারা উভয়েই করিয়াছিল, কিন্ত মৃত্যুঞ্জয় তো পল্লিগরামেরই ছেলে, পাড়ার্থীয়ের তেলে-জলেই তো মানুষ । তবু অত বড় দুঃসাহসের কাজে প্রবৃত্ত করিয়াছিল তাহাকে যে বন্তটা সেটা কেহ একবার চোখ মেলিয়া দেখিতে পাইল না?

আমার মনে হয়, যে দেশের নরনারীর মধ্যে পরস্পরের হৃদয় জয় করিয়া বিবাহ করিবার রীতি নাই, বরঞ্চ তাহা নিন্দার সামগ্রী, যে দেশে নরনারী আশা করিবার সৌভাগ্য, আকাঙ্ক্ষা করিবার ভয়ংকর আনন্দ হইতে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত, যাহাদের জয়ের গর্ব, পরাজয়ের ব্যথা কোনোটাই জীবনে একটিবারও বহন করিতে হয় না, যাহাদের ভুল করিবার দুঃখ, আর ভুল না করিবার আত্রপ্রসাদ, কিছুরই বালাই নাই, যাহাদের প্রাচীন এবং বহুদর্শী বিজ্ঞ সমাজ সর্ব প্রকারের হাঙ্গামা হইতে অত্যন্ত সাবধানে দেশের লোককে তফাৎ করিয়া, আজীবন কেবল ভালোটি হইয়া থাকিবারই ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, তাই বিবাহ ব্যাপারটা যাহাদের শুধু নিছক Contract তা সে যতই কেননা বৈদিক মন্ত্র দিয়া Document পাকা করা হোক, সে দেশের লোকের সাধ্যই নাই মৃত্যু্জয়ের অন্নপাপের কারণ বোঝে । বিলাসীকে যাহারা পরিহাস করিয়াছিলেন, তাহারা সাধু গৃহস্থ এবং সাধবী গৃহিণী_ অক্ষয় সতীলোক তীহারা সবাই পাইবেন, তাও আমি জানি কিন্তু সেই সাপুড়ের মেয়েটি যখন একটি গীড়িত শয্যাগত লোককে তিল তিল করিয়া জয় করিতেছিল, তাহার তখনকার সেই গৌরবের কণামাত্র হয়ত আজিও ইহাদের কেহ চোখে দেখেন নাই। মৃত্যুপ্তয় হয়ত নিতান্তই একটা তুচ্ছ মানুষ ছিল, কিন্তু তাহার হৃদয় জয় করিয়া দখল করার আনন্দটাও তুচ্ছ নয়, সে সম্পদও অকিঞ্িৎকর নহে।


এই বন্তুটাই এ দেশের লোকের পক্ষে বুঝিয়া উঠা কঠিন । আমি ভূদেববাবুর পারিবারিক প্রবন্ধেও দোষ দিব না এবং শাস্ত্রীয় তথা সামাজিক বিধি-ব্যবস্থারও নিন্দা করিব না। করিলেও মুখের ওপর কড়া জবাব দিয়া যাহারা বলিবেন, এই হিন্দু সমাজ তাহার নির্ভুল বিধিব্যবস্থার জোরেই অত শতাব্দীর অতগুলো বিপ্লবের মধ্যে বাচিয়া নয়, এবং অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে । আমি শুধু এই বলিব যে, বড়লোকের নন্দগোপালটির মতো দিবারাত্রি চোখে চোখে এবং কোলে কোলে রাখিলে যে সে বেশটি থাকিবে, তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই, কিন্তু একেবারে তেলাপোকাটির মত বাঁচাইয়া রাখার চেয়ে এক আধবার কোল হইতে নামাইয়া আরও পাঁচজন মানুষের মতো দু-এক পা হাঁটিতে দিলেই প্রায়শ্চিত্ত করার মত পাপ হয় না।


পাঠ-পরিচিতি - শরৎচন্দ্রের “বিলাসী” গল্পটি প্রথমে প্রকাশিত হয় “ভারতী” পত্রিকায় ১৩২৫ বঙ্গাব্দের (১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ) বৈশাখ সংখ্যায়। “ন্যাড়া” নামের এক যুবকের নিজের জবানিতে বিবৃত হয়েছে এ গল্প। এই গল্পের কাহিনিতে শরৎচন্দ্রের প্রথম জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে।  “বিলাসী” গল্পে বর্ণিত হয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী দুই মানব-মানবীর চরিত্রের অসাধারণ প্রেমের মহিমা, যা ছাপিয়ে উঠেছে জাতিগত বিভেদের সংকীর্ণ সীমা । গল্পে সংঘটিত একের পর এক ঘটনা এবং বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে সংঘাতের মাধ্যমেই কাহিনি অগ্রসর হয় । ঘটনার দ্বন্ধ-সংঘাতের মধ্য দিয়ে কাহিনিতে গতি সঞ্ারিত হয়েছে লেখক কোন অবস্থান থেকে কাহিনি বলছেন, সেটা অনেক সময় কাহিনি বর্ণনায় গুরুতপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । লেখক সর্বদর্শী অবস্থান থেকেও কাহিনি বর্ণনা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি সবগুলো চরিত্র ও  টনা_ নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বর্ণনা করেন। যেমনটি দেখা যায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র “লালসালু* উপন্যাস এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “মাসি-পিসি” গল্পে । পক্ষান্তরে গল্পটি উত্তম পুরুষের ভাষ্যেও বর্ণিত হতে পারে এক্ষেত্রে গল্পে আমি, আমাকে ইত্যাদি সর্বনাম এসে যায়। এরকম ক্ষেত্রে কখনো-কখনো লেখক নিজেই কাহিনির একটা চরিত্রের ভূমিকা নেন, হয়ে ওঠেন কথক । “বিলাসী” গল্পে লেখক সেই ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। বর্তমান সংকলনের “অপরিচিতা”, “আহ্বান” ও “তাজমহল” গল্পে উত্তমপুরুষের ভাষ্য গৃহীত হয়েছে। “বিলাসী” গল্পের নাম চরিত্র কর্মনিপুণ, বুদ্ধিমতী ও সেবাব্রতী বিলাসী; শরৎসাহিত্যের অন্যান্য উজ্জ্বল নায়িকাদের মতোই একজন । যে প্রেমের জন্যে নির্দিধায় বেছে নিয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ আর তার প্রেমের মহিমাময় আলোয় ধরা পড়েছে সমাজের অনুদারতা ও রক্ষণশীলতা, জীবনের নিষ্ঠুর ও অশুভ চেহারা।


সৃজনশীল প্রশ্ন - উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহপুত্র মিহিরের স্ত্রী খনা। একদিন পিতা বরাহ এবং পুত্র মিহির আকাশের তারা গণনা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে খনা এ সমস্যার সমাধান দেন। রাজা বিক্রমাদিত্য তার গুণে মুগ্ধ হন। গণনা করে খনার দেওয়া পূর্বাভাসে রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হতেন বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ব হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু খনার এই খ্যাতি ও সম্মান অল্প সময়ের মধ্যেই তার জীবনে বিড়ম্বনা নিয়ে আসে । রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে ও নারীর জ্ঞানের কাছে নিচু হওয়ার লজ্জায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বরাহের আদেশে মিহির খনার জিহ্বা কেটে দেন। এর কিছুকাল পরে খনার মৃত্যু হয়।

ক. খুড়া কোন বংশের?

খ. “ইহা আর একটি শক্তি'- বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

গ. বিলাসী চরিত্রের কোন দিকটি খনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ তা বর্ণনা কর।

ঘ. 'মৃত্যুপ্তয় ও মিহির পরস্পর বিপরীত চরিত্রের মানুষ ।'_ মন্তব্যটি যাচাই কর। 

Post a Comment

1 Comments