Latest courses

কবিতা ॥ অলঙ্কার ॥ ছন্দ

 

কবিতা ॥ অলঙ্কার ॥ ছন্দ

উদ্দেশ্য

টিপ রানে লাদি

কবিতার সংজ্ঞার্থ সম্পর্কে ধারণা ব্যক্ত করতে পারবেন।

বিতার ভাব ও রূপের সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।

 কবিতার বিচিত্র রূপ-রীতি সম্পর্কে লিখতে পারবেন।

 প্রধান প্রধান অলঙ্কার সম্পর্কে লিখতে পারবেন।

 ছন্দ কাকে বলে সে-সম্পর্কে ধারণা ব্যক্ত করতে পারবেন।


কবিতা - কবিতা নিয়ে কথা বলা যতো সহজ এর সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা ততোটা সহজ কাজ নয়। কবিতা পছন্দ করেনা পৃথিবীতে এরকম লোকের সংখ্যা খুবই কম। কবিতা সম্পর্কে যতো আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে, সাহিত্যের অন্য কোন রূপ সম্পর্কে তা হয়নি। প্রত্যেক সচেতন সংবেদনশীল মানুষের মধ্যেই কবিতার প্রতি আকর্ষণ রয়েছে। মানুষের বিস্ময়, স্মৃতি, স্বপ্ন, কল্পনার এক অপরূপ মিশ্রণে কবিতার সৃষ্টি ব্যক্তির অনুভূতি, আবেগ, রহস্যানুভূতি প্রতিফলন ঘটায় প্রতিটি যথার্থ কবিতাই এক হ্বতত্ সৃষ্টি । যথার্থ বলার কারণ, অনেক অনুকারী কবিতা আছে যেখানে মৌলিক অনুভবের পরিবর্তে অন্য কোন কবির অনুভূতি, আবেগ ও সৃষ্টিশীল কল্পনার প্রতিধ্বনিই মুখ্য হয়ে ওঠে। 

উপরের আলোচনা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, কবিতার সংজ্ঞার্থ নির্ণয় সহজ কাজ নয়। তবুও সাহিত্যের প্রতিটি শাখারই একটি মৌলিক মানদন্ড আছে। সে মানদন্ড বিচার করে কবিতা সম্পর্কেও একটা মোটামুটি ধারণা অর্জন করা যেতে পারে । বিশেষ অনুভূতি প্রকাশের জন্য শন্দগুচ্ছের তাৎপর্যময় বিন্যাস থেকে কবিতার সৃষ্টি কিন্তু এ-ধারণাও পূর্ণাঙ্গ নয়। আরো সুস্পষ্ট করে বলা যায় আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, কল্পনা প্রভৃতি ব্যক্তিমানসের সাধারণ প্রবণতার অংশ; এগুলোর সঙ্গে যখন সৃষ্টিশীলতা যুক্ত হয়, অনিবার্ধ শাব্দের তাৎপর্যময় বিন্যাস তাকে করে তোলে ব্যস্তনাময়। তখনই একটি কবিতার জন্ম সম্ভব হয়। এ গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত পাঁচটি কবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের বিশেষণ থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌছার চেষ্টা করতে পারি।

মাইকেল মধুসুদন দত্তের 'বঙ্গভাষা' কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে মাতৃভাষাপ্রেম ও গভীর দেশাত্ববোধ। কৰি সনেটের আঙ্গিকে নিজের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা ও আত্মবিশেষণ থেকে মাতৃভাষার টানে স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়েছেন। চৌদ্দ মাত্রার চৌদ্দ চরণের সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনিবার্ধ কিছু শব্দের বিন্যাসের মাধ্যমে কৰি নিজ অনুভূতি, আবেগ, স্মৃতি, স্বপ্ন ও বাতব প্রাপ্তির পরিপূর্ণ ছবি তুলে ধরেছেন এই কবিতায়। “বলাকা' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আবেগের বেগকে স্ুষ্টিজগতের অন্তর্নিহিত অবিরাম গতির ছন্দে অনুভব করেছেন। এ-কবিতায় শব্দ-ব্যবহার ও ছন্দ-পরিকল্পনা কবির অনুভূত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কাজী নজরুল ইসলামের 'বাতায়ন পাশে গুবাক-তরুর সারি' কবিতায় প্রেমচেতনা ও প্রকৃতিচেতনার অনুপম মেলবন্ধন ঘটেছে। “বনলতা সেন' সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের বহুল পঠিত কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম । ব্যক্তিপ্রেম কিংবা দেশপ্রেম যাই-ই ব্যক্ত হোকনা কেন, হাজার বছরের পথচলার ক্লান্ত পরিবাজক যখন উচ্চারণ করে __ বলেছে সে, “এতদিন কোথায় ছিলেন?/ পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।” __ তখন দেশকালের সীমা লুপ্ত হয়ে মানুষের চিরকাঙ্ফিত শুশবষার মমতাগ্লিদ্ধ নারীর মাতৃমূর্তিই প্রধান হয়ে ওঠে । হাসান হাফিজুর রহমানের 'অমর একুশে" ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত কবিতা । এ-কবিতায় মাতৃভাষাপ্রেম ও দেশপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শোষণের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং সংগামের দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা।


পাঁচটি কবিতার বিষয়বস্তুর মতো আঙ্গিকরীতিও স্বতন্ত্র । শব্দচয়ন ও ব্যবহারে প্রত্যেক কবির রুচি আলাদা । কিন্তু প্রতিটি কবিতাই আমাদের মধ্যে স্থায়ী আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম । সুতরাং সাধারণভাবে বলা যায়, কবির স্বতক্ফুর্ত অনুভূতি শব্দ ও ছন্দের অনিবার্ধ বিন্যাসে জীবনের অন্তর্ময় এবং স্থায়ী আবেদন সৃষ্টির উপযোগী যে শব্দসৌধ সৃষ্টি করে তাই-ই কবিতা ।

কবিতার শ্রেণীকরণ - প্রতিটি সাহিত্য আঙ্গিকেরই উপাদান মানুষের জীবন, পারিপার্শক সমাজ অর্থাৎ মানুষের চিন্তা ও কর্মের সঙ্গে সংশিষ্ট সকল প্রসঙ্গ । জীবনকে দেখার এবং উপস্থাপন করার বৈশিষ্ট্যই সাহিত্যের প্রতিটি আঙ্গিককে স্বতন্ত্র করে দেয়। আবার এইসব সাহিত্যরূপের মধ্যে বিষয়বস্তু, আঙ্গিকবিন্যাস ও ভাষারীতির কারণে শ্রেণীকরণ অনিবার্য হয়ে পড়ে। কবিতার বিষয়ে জানতে হবে ।

প্রথমে একটি ছকের সাহায্যে আমরা কবিতার বিভিন্ন শ্রেণীর অবস্থান নির্দেশ করতে পারি:


কাব্যনাট্য - আদিযুগে কাব্যভাষাই ছিলো সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। ফলে, নাটকের প্রাথমিক রূপ কাব্যনাটকেও কবিতার ভাষা ও ছন্দরীতি অনুসৃত হতো । গ্রীক বা রোমান সাহিত্যের স্বর্ণযুগে নাটককে বলা হতো জীবনের অনুকরণ, ঘনিষ্ট প্রতিফলন । এলিজাবেখান যুগের কালজয়ী নাট্যকার শেক্সপীয়রের নাটকগুলো জীবনের বহুমুখী বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করলেও কবিতার রূপরীতিই ছিলো তার প্রধান অবলম্বন। সাধারণ দর্শক-শ্রোতার নিকট গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নাট্যসংলাপের ভাষাকে লৌকিক ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসেন নাট্যকাররা। মৌখিক ভাষার স্পন্দন নাটকের কাব্যগুণকে কিছুটা খণ্ডিত করলেও পরবর্তীকালে নাটকে গদ্যভাষার প্রয়োগ অনিবার্য করে তোলে কিন্তু কাব্যনাট্যের ধারা সাহিত্যের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ হয়নি। উনিশ শতকে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু কাব্যনাটকের রূপরীতি , ভাষা ও ছন্দকে মানুষের পরিবর্তনশীল সাহিত্যরুচির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রভূত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে সৈয়দ শামসুল হক কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে গভীর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও শিল্পসাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।


মহাকাব্য - কবিতার প্রাচীনতম শাখা যে মহাকাব্য, এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। গ্রীক Epos শব্দের ইংরেজি রূপান্তর Epic মহাকাব্যের ইংরেজি প্রতিশব্দ। Epos-এর প্রাটীন অর্থ ছিলো শব্দ। সময়ের বিবর্তনে এই শব্দের ওপর বিভিনন অর্থ আরোপিত হয়ে কখনো বিবরণ বা কাহিনী, কখনো গীতি বা বীরত্ৃব্যগ্রক কাব্য। এভাবেই অর্থের রূপান্তর ঘটতে ঘটতে এক সময় Epic-এর অর্থ দাঁড়িয়ে যায় আখ্যানমূলক বা বীরত্বব্যজ্রক কবিতা । 

খ্রীক সাহিত্যতান্তিক আযারিস্টটল তার কালজী গ্রন্থ “পোয়েটিক্স'-এ ট্রযাজেডির ওপর বিষ্তুত আলোচনা করতে গিয়ে মহাকাব্যের লক্ষণ ও স্বরূপ সম্পর্কেও মন্তব্য করেছেন। কাহিনীর বিস্তার-ধর্মিতা, ওজোগুণ-সম্পন শন্দপ্রয়োগ ও হেকটামিটার ছন্দ মহাকাব্যের গঠনরীতির বিশেষত্ব ও স্বাতত্র্য। আ্যারিস্টটল আর যে দুটি লক্ষণের কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

প্রথম লক্ষণ: বস্তুনিষ্ঠা বা Objectivity___ কবির নির্লিপ্ততা, নিরাস্তি। ঘটনা বা কাহিনীর অন্তরালে কবির নিরপেক্ষ অবস্থান বা আত্মগোপন করার ক্ষমতা ।


দ্বিতীয় লক্ষণ: অলৌকিক বিষয়বন্তুকে কাব্যসম্মতভাবে রূপদান করা । এ সম্পর্কে আ্যারিস্টটলের একটি মন্তব্য মুল্যবান __ অবিশ্বাস্য সম্ভবের চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অসম্ভব অনেক বেশি কাম্য ।

মহাকাব্যের বিষয়বিন্যাস ও গঠনকৌশালে বৈচিত্র্য, ব্যাপকতা ও অভিনবত্ব সুস্পষ্ট । এর ঘটনা বা পট গ্রন্থনে আদি-মধ্য- অন্ত্ের এক্য থাকতে হবে, নায়ক বীর্যবন্তা ও দক্ষতায় বহুগুণে গুণান্বিত। এর বস্ত-উপাদান জাতীয় জীবনের এরতিহাসিক বা পৌরাণিক তথ্য ও ঘটনা, এর অনুপ্রেরণা-উৎ্দ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এশীশক্তি। মহাকাব্যে মানব-দানব, দেব-দেবী চরিত্রের সমাবেশ ঘটায় অলৌকিকতার প্রয়োগ ঘটে থাকে ।

মহাকাব্য দুই প্রকার:

১. জাত মহাকাব্য (Epic of Growth): এতে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের যৃথবদ্ধ জীবনপ্রণালী, মানব-মানবীর আচার- আচরণ-বিশ্বাস, প্রেম-সংগ্বাম বিন্যস্ত হয়। নির্দিষ্ট সময়খন্ডের পরিবর্তে একটি সমাজের অতীত বর্তমানের দীর্ঘ সয়-সীমা জাত মহাকাব্যে অনুসৃত হয়। ব্যক্তিবিশেষ রচনা করলেও জাত মহাকাব্যে সামাজিক ঘটনা-পরিক্রমা ও জীবনের সমাঘিক রূপায়ণ ঘটে। বালীকি রচিত 'রামায়ণ' ও কৃষঃদৈপায়ন ব্যাসকৃত “মহাভারতে'র ঘটনা, বিষয়বন্ত ও চরিত্রের বৈচিত্র্য ভারতবর্ষের অদিকালের গোটা সমাজ ব্যবস্থাকেই উন্মোচন করেছে।

হোমার রচিত ইলিয়ড ও ওডেসি প্রাচীন গ্রীসের যৌথ সমাজব্যবস্থার মহাকাব্যিক রূপ । ইলিয়ড-এ ট্রয়যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের কাহিনী অবলদ্বিত হলেও দশ বছর ব্যাপ্ত যুদ্ধের সমগ্র ছবিই কবির খন্থণ-নৈপুণ্যে এতে বিধৃত হয়েছে। ওডেসিতে ট্রয় যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইথাকা রাজ্যের জনজীবন, নায়ক ওডেসিয়ুসের অবিশ্বাস্য ভ্রমণ ও সংগ্রাম এবং পেনিলোপির বিড়দ্বিত-ভাগ্য জীবন। হোমার ঘটনাভারাক্রান্ত মহাকাব্যে চরিত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন । 

২. সাহিত্যিক মহাকাব্য (Literary epic): এ জাতীয় মহাকাব্য পৌরাণিক ঘটনা কিংবা কোন জাত মহাকাব্যের ঘটনাসুত্র অবলম্বনে কবির যুগমানস, সমাজমানস ও দৃষ্টিভঙ্গির সমবায়ে এক আধুনিক সৃষ্টি। এই শ্রেণীর মহাকাব্যের মধ্যে ভার্জিলের “ঈনিদ' (Eneid) তাসোর 'জেরুজালেম ডেলিভার্ড' (Jerusalum Delivered), দান্তের “ডিভাইন কমেডি" (Divine Commiedia), জন মিল্টনের 'প্যারাডাইস লস্ট" (Paradise Last) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদবধ" কাব্য উলেখযোগ্য। পুরাতনের আশ্রয়ে নতুন যুগের জীবনসত্য প্রতিটি সাহিত্যিক মহাকাব্যেরই বিষয়বস্ত। 

গীতিকবিতা - ব্যক্তি-অনুভূতির স্বত-ফুর্ত প্রকাশ গীতিকবিতার প্রধান লক্ষণ। সাবলীলতা ও সহজতায় এই কাব্য-আঙ্গিক সর্বাপেক্ষা বৈচিত্র্যময় ও প্রভাবশালী । প্রাচীন গ্রীসে বীণাযন্ত্র সহযোগে যে সঙ্গীত পরিবেশিত হতো , তাকে বলা হতো Lyric | এ থেকে বোঝা যাচ্ছে Lyric বা গীতিকবিতার সঙ্গে সঙ্গীত ধর্মের সম্পর্ক সুনিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা একই সঙ্গে কবিতা ও গান। তবুও মনে রাখতে হবে সঙ্গীত অপেক্ষা গীতিকবিতার ক্ষেত্র বহুবিচিত্র। মানবীয় অনুভূতির বহুমুখী সত্য গীতিকবিতায় রূপ পায়। সঙ্গীতে থাকে সুরের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ, আর গীতিকবিতায় কথা ও সুরের সমন্বয়। ফলে, সঙ্গীত অপেক্ষা গীতিকবিতার ক্ষেত্র বহুগুণে বিস্তুত। ব্যক্তি অনুভূতির সৃক্ষমতর প্রকাশ অনিবার্ধ শব্দ, ধ্বনি এবং ছন্দোবিন্যাসে গীতিকবিতায় রূপ পায় বলে আদিকাল থেকেই কবিতার এই রীতি সর্বাধিক চর্চিত সাহিত্যধারা। এ-প্রসঙ্গে মহাকাব্যের সঙ্গে গীতিকবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকগত পার্থক্যের স্বরূপ নির্দেশ করা প্রয়োজন। মহাকাব্যের বিষয় আঙ্গিক ও পূর্বনিরূপিত আর গীতিকবিতার বিষয়, রীতি ও সময়, সমাজ ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । মহাকাব্য বস্তুনিষ্ঠ (Objective) আর গীতিকবিতা ভাবনিষ্ঠ (Subjective) কবিতা । 

গীতিকবিতার বিচিত্র রূপ-রীতি - লিরিক বা গীতিকবিতার জনপ্রিয়তার ও ধারাবাহিকতা উত্স এর রূপগত বৈচিত্র্য থেকেই অনুধাবন করা সম্ভব । স্তবসঙ্গীত বা [Hymn] সৃষ্টিকর্তা বা দেবতার উদ্দেশে রচিত প্রার্থনামূলক কবিতাকে বলা হয় হিম্‌ বা ভ্তব সঙ্গীত। এ ধরনের কবিতা জনসাধারণের সামনে গাওয়া হতো আবার আবৃত্তিও করা হতো । অর্থাৎ সঙ্গীতধর্ম বা কাব্যগুণ উভয়ই স্তবসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য। আধ্যাত্মিকতা ও ভক্তিভাব এ-কবিতার প্রাণ। শ্রোতাসাধারণের মনে মহৎ ভাবনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে বসঙগীত রচিত হতো। প্রাটান ও মধ্যযুগের সাহিত্যে এ-ধরনের সঙ্গীতধর্মপ্রধান কবিতা হয়েছে প্রচুর। বৈষ্ণব পদাবলী, শ্যামাসঙ্গীত ও বাউল গানে ত্তবসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য সুস্পট। রবীন্দ্রানাথ ঠাকুরের 'গীতাঞ্জলি' 'গীতিমাল্য', ও 'নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় ভ্তবসীঙ্গত বা Hymn এর বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। 


স্তোত্রকবিতা বা ওড্‌ (Ode) - বাংলা ভাষায় ওড্‌-এর কোন প্রতিশব্দ নেই। বিষয়বন্ত ও গঠনবৈশিষ্ট্য অনুসারে একে স্তোত্রকবিতা বলা যেতে পারে । কৰি কোনো মহৎ ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ব্যক্তি বা বস্তুর উদ্দেশে সমিল বা অমিল ছন্দে যে কবিতা রচনা করেন তাই-ই ওড্‌ ব স্তোত্র কবিতা । প্রাচীন গ্রীক কবি পিন্ডার ওড্‌ রচনার ক্ষেত্রে গথিকৃত। রোমান কবি হোরেসও বেশ কিছু ওড্‌ রচনা করেছেন । বাংলা সাহিত্যে সচেতনভাবে ওড্‌ রচনার সূত্রপাত মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'ব্রজাঙ্গনা" কাব্য থেকে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বসুন্ধরা, "সমুদ্রের প্রতি' কিংবা উর্বশী ওড্‌-এর আধুনিক রূপায়ণ। ওড্‌-এর লক্ষণযুক্ত উল্লেযোগ্য সংখ্যক কবিতা আধুনিক বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে।

শোককবিতা বা এলিজি (Elegy) - মূল শরীক শব্দ Elegia-এর অর্থ হলো বেদনার আর্তি। এই শব্দ থেকে Elegy শব্দের উৎপত্তি । Elegia বা Elegos কেবল শোক অর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হতো না। প্রাচীন গ্রীক এবং ল্যাটিন সাহিত্যে এলিজিয়াক (Elegiac) নামে ৬+৫ মাত্রায় ( প্রথমে ছয় পরে পাঁচ) রচিত এক ধরনের কবিতা প্রচলিত ছিলো । সময়ের বিবর্তনে এলিজি বলতে এখন কেবল শোক কবিতাকেই বোঝায়। এ-রীতির কবিতায় কবির ব্যক্তিগত শোক কিংবা জাতীয় শোক রূপায়িত হয়। প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত বিচ্ছেদ-বেদনা, কোনো জাতীয় ব্যক্তিত্বের মৃত্যুজনিত উপলব্ধি থেকে শোককবিতার সৃষ্টি । গ্রীক কবি বিয়ন রচিত Lament for Adonis বিশেষ ধরনের শোককবিতা Pastal Elegy-র আদি দৃষ্টান্ত। জন মিল্টনের Licidus এবং শেলির Adonis এই ধারার আরো অগ্রসর পর্যায়ের কবিতা । বিয়নের কবিতা শোকেই শুরু এবং সমাপ্তি। কিন্তু মিল্টন এবং শেলি তাঁদের শোকের মধ্যে প্রত্যাশা ও আনন্দের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। টমাস গ্রের Elegy written in country churchyard সবাধিক পঠিত শোক কবিতা । প্রিয়জন কিংবা কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়, নাম না-জানা কোনো গ্রামের মৃত কৃষিজীবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে কবিতাটি টেনিসনের এলিজিগুচ্ছের নাম  In Memorium | বাংলা ভাষায় শোককবিতা রচিত হয়েছে প্রচুর । কিন্ত সে-তুলনায় কালোতীর্ণ কবিতার সংখ্যা কম। প্রায় সকল কবিই শোককে ভাষারূপ দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত স্ত্রীর উদ্দেশে রচিত কবিতা গুচ্ছ “্মরণ' শোককবিতারই আধুনিক রূপায়ন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের “২২শে শ্রাবণ-১৩৪৮", মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুতে প্রেমেন্্র মিত্রের লেখা “তিনটি গুলি", মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু উপলক্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচিত * পাথরের ফুল", শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সার্থক এলিজির দৃষ্টান্ত। দেশবন্ধু চিন্তরঞ্রন দাসের অকাল প্রয়াণে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন 'চিন্তনামা' | জসীমউদ্দীনের 'কবর' পারিবারিক শোককবিতার অনন্য দৃষ্টান্ত ।


সনেট বা চতুর্দশপদী - সনেট শব্দটির উৎপত্তি ইটালিয়ান Soneto (অর্থ মৃদুধ্বনি) শব্দ থেকে । ইটালীয় কবি দান্তে ও পেত্রার্ক সনেটের আদি রচিয়তা। একটি অখন্ড অনুভুতি যখন ১৪ মাত্রার (কখনো কখনো ১৮ মাত্রাও হয়) ১৪ পংক্তিতে ( কখনো কখনো ১৮ পংক্তির ব্যবহারও দেখা যায়) বিন্যস্ত হয়ে আবেগের শিখর স্পর্শ করে, তখনই একটি সার্থক সনেট জন্ম নেয়। বাংলা সাহিত্যের আদি এবং সার্থক সনেট রচিয়তা মাইকেল মধুসূদন দত্ত সনেটের আঙ্গিককে “চতুর্দশপদী' হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন। পরবর্তীকালের সার্থক সনেট রচিয়তাগণ এই রীতিই মূলত অনুসরণ করেছেন। সনেটের প্রথম আট পংক্তিকে বলা হয় অষ্টক (Octave) এই প্রথম অংশে কবির ভাব বা কল্পনা ঈঙ্গিতময় রূপ লাভ করে। শেষ ছয় চরণকে বলা হয় ঘটক (Sestet) __ এ-অংশে পূর্ববর্তী ভাবের বিস্তৃতিসাধন বা ব্যাখ্যা দান করা হয়। সনেটের বক্তব্য বিন্যাসের এই রীতি মধুসূদন দত্ত অনুসরণ করেছেন । তাঁর 'বঙ্গভাষা" কবিতাটি বিশেষণ করলে এ-মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হবে । বঙ্গভাষা' কবিতার প্রথম আট চরণে (পাঠক্রমভুক্ত কবিতাটি সামনে নিয়ে বসুন) কবি নিজের আত্মরপান্তরের ঈঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, বঙ্গভান্ডারে বিচিত্র রত্রসন্ভার থাকা সত্তেও তিনি মত্ত থেকেছেন পর-সম্পদ লোভে। পরদেশে (বিদেশে) ভ্রমণ করে জীবনযাপনের মধ্যে ভিক্ষাবৃত্তির মতো অভিরুচিই ফুটে ওঠে। ব্যর্থ সাধনায় তাঁর জীবনে সাফল্যের পরিবর্তে এসেছে হতাশা । মাতৃভূমি রূপ পদ্মকানন পরিত্যাগ করে শৈবালের আবেষ্টনীতে আবদ্ধ থেকে নষ্ট করেছেন জীবনের সকল সন্তাবনার পথ। এই অংশে কবির আত্মবিশেষণ প্রাধান্য পেয়েছে। পরবর্তী ছয় চরণে কৰি কুললক্ষ্মী তথা দেশমাতৃকার পথনির্দেশনা পেয়ে যান স্বগ্নে। 'পালিলাম আজ্ঞা সুখে ; পাইলাম কালে/ মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।' অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সতর্কতায় মধুসূদন সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার আঙ্গিক নিমম্ণ করেছিলেন ।


ব্যালাড (Ballad) - গীতিকবিতার আদিরূপ হিসেবে বিচার করা যায় ব্যালাড বা গীতিগাথাকে। ইতালীয় শব্দ বালারে (১৪1199) থেকে ব্যালাড শব্দের উৎপত্তি। বালারে শব্দের অর্থ “নৃত্য করা'। অর্থারৎ্থ কবিতার সঙ্গে নৃত্য ও নাটকীয়তার মিশ্রণে ব্যালাডের সৃষ্টি। ব্যালাড-এ প্রেম, ধর্ম, বীরত্ব, রাজনীতি, সামাজিক প্রসঙ্গ, হাস্যরস ও করুণরসের ঘটনা স্থান পেত। আদি ব্যালাডগুলোর রচয়িতারা অজ্ঞাতনামা । মূলত লোকজীবন তথা গ্রামজীবনের বিচিত্র প্রসঙ্গ ব্যালাভ-এ স্থান পেয়েছে। এতে ব্যক্তি কিংবা সামষ্টিক জীবনের বেদনাকরুণ কাহিনীরই প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। আধুনিক রোমান্টিক যুগের কবিরা ব্যালাডের অনুসরণে লিখেছেন প্রচুর কবিতা । ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হার্ডি, কোলরিজ, কীট্স, মেরিডিথ, সুইনবার্ন প্রমুখ কবি ব্যালাডের অনুসরণে প্রচুর কবিতা লিখেছেন। 

বাংলা ভাষার ব্যালাড জাতীয় আদি রচনা মৈমনসিংহ গীতিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কথা ও কাহিনী' কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় মারাঠী ব্যালাডের অনুরণন আছে। রবীন্দ্রনাথই ব্যালাডের আধুনিক শিল্পসম্মত রূপকার জসীমউদ্‌দীনের 'নকসীকাঁথার মাঠ' ও “সোজন বাদিয়ার ঘাট" ব্যালাডের নিদর্শন হিসেবে অতুলনীয়। 


বাংলা কবিতা - বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন “চর্যাপদ'। ৭৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বৌদ্ধ সহজিয়ারা “চর্যাপদ' রচনা করেছিলেন। ধর্মের গৃঢ় রহস্য এর বিষয় হলেও সমকালের সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক এতে প্রতিফলিত হয়েছে। রয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগে প্রবেশ করে বড়ু চক্তীদাসের '্রীকৃষ্ণকীর্ত্ন' কাব্যের মাধ্যমে। মধ্যযুগে বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি ঘটে বিচিত্রধারায়। নাথসাহিত্য, ধর্মমঙ্গল, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ঞব পদাবলী, জীবনী কাব্য, অনুবাদকাব্য, রোমাসমূলক প্রণয়কথা (কারো কারো মতে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান) প্রভৃতি বিষয়ভাবনা ও রূপবৈচিত্রযে বাংলা কবিতার বিকাশ ও উত্তরণে ভূমিকা পালন করেছে। 

বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ইউরোপীয় শিক্ষা- সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রভাবে বাঙালি জীবনে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ঘটে । ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০), হিন্দু কলেজ (১৮১৭), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) প্রভৃতি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এদেশে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাভাবনা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় প্রথম আধুনিক জীবনের লক্ষণসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম সর্বাঙ্গীন আধুনিক কবি । বিহারীলাল চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের হাতে আধুনিক বাংলা কবিতা আন্তজাতিক মান স্পর্শে সক্ষম হয়। কবিতার বিষয় ও রূপ-রীতি উদ্ভাবনে বাঙালি কবিরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। 

বাংলা কবিতার এক স্বতন্ত্র ধারা বাংলাদেশের কবিতা । অভিন্ন ভাষায় রচিত হলেও সামাজিক রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে বাংলাদেশের কবিতা পশ্চিমবাংলার কবিতা থেকে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে স্বতন্র। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কবিতা নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে । ১৯৫২ খিস্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের অভিজ্ঞতায় আমাদের কবিতায় যে চেতনা জন্মা নেয় পৃথিবীর কোনো দেশের সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে না। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এই সমাজ ও তার কবিতা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার হয়ে ওঠে ।


বাংলাদেশের কবিতা - বাংলাদেশের কবিতায় স্বতন্ত্র ভিত্তি রচিত হয় চলিশের দশকে । সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্বতন্র ধারার সঙ্গে শিশ্পৃষ্টির নতুনত্ব এসময়ের কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে। এ-সময়ে আবির্ভ্ত কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৬), আবুল হোসেন (১৯২১-), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-) প্রমুখ উলেখযোগ্য । আবুল হোসেনের “নববসন্ত' (১৯৪০), ফররুখ আহমদের “সাত সাগরের মাঝি" (১৯৪৫), সৈয়দ আলী আহসানের "চাহার দরবেশ' (১৯৪৫), আহসান হাবীরের 'রাত্রিশেষ' (১৯৪৭) কাব্যে উপকরণ, জীবনজিজ্ঞাসা ও শিল্পরীতির স্বাতব্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। 

পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্প-ভাবনায় যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়। এ-সময়ের কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুলাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গনি হাজারী, আজীজুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী উলেখযোগ্য।

ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে নবোদ্ভ‚ত মধ্যবিত্তের জীবনচেতনার রূপায়ণে এ-পর্যায়ের কবিতা এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

ষাটের দশকে আবিভর্‚ত কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মাহবুব সাদিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ উলেখযোগ্য। পাশ্চাত্য কবিতার ধ্যানধারণার সঙ্গে ব্যক্তিমানসের নিভৃতচারিতা ও রাজনীতি সচেতনতা এঁদের কবিতার স্বভাবধর্ম।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এ-সময়ে উলেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ কবির আবির্ভাবে বাংলাদেশের কবিতায় নতুন প্রাণবন্যা সূচিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কবিতা যাঁদের সাধনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আবিদ আজাদ, সানাউল হক খান, সাজ্জাদ কাদির, সিকদার আমিনুল হক, আল মুজাহিদী, মাহবুব হাসান, হেলাল হাফিজ, রুদ্রমুহম্মদ শহীদুলাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রমুখ উলেখযোগ্য।

অলঙ্কার - কবিতার প্রকরণ বা শিল্পরূপ অনুধাবনের জন্য অলঙ্কার, চিত্রকলা বা Image, ছন্দ এবং ছন্দস্পন্দ সম্পর্কেধারণা থাকা অত্যন্তজরুরি। অলঙ্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ [অলম্-কৃ (করা) + ঘঞ্ ণ] আভরণ বা ভ‚ষণ। অর্থাৎ যে-সকল উপাদান কবিতার অবয়বকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে সাধারণ অর্থে তাই অলঙ্কার। কিন্তু কবিতা এমন একটি শিল্পমাধ্যম, যেখানে অলঙ্কার বহিরঙ্গ উপাদান হিসেবে গৃহীত হয়নি, অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। অনুভ‚তি বা চেতনা প্রকাশের প্রয়োজনে কবি প্রথমে অনিবার্য কিছু শব্দ নির্বাচন করেন। অতঃপর চেতনা ও শব্দের এমন একটি মেলবন্ধন ঘটান যেখানে একটি থেকে আরেকটিকে বিচ্ছিন্নকরলে কবিতারই অপমৃত্যু হয়।

প্রাচীন গ্রীসে অলঙ্কার-শাস্ত্রে র উদ্ভব হয়। ঐ সময়ে গ্রীক মনীষীরা কাব্যতত্তে¡রও উদ্ভাবন করেন। এ-দুয়ের মধ্যে তাঁরা সুস্পষ্ট পার্থক্যও নির্ধারণ করেছিলেন। অলঙ্কার বা Rhetoric-এর লক্ষ্য ছিলো কাব্যের বাগ্মিক্সতা ও রচনার গুণাগুণ নির্দেশ করা আর কাব্যতত্ত¡ বা Poetics-এর বিচার্য ছিলো বিভিন্ন সাহিত্য-আঙ্গিকের (যেমন ট্র্যাজেডি, কমেডি, মহাকাব্য প্রভৃতি) প্রকৃতি ও রচনারীতির বিশেষণ। প্রাচীন ভারতেও অলঙ্কারশাস্ত্রএবং কাব্যতত্তে¡র ব্যাপক চর্চা হয়েছে এবং এক পর্যায়ে অলঙ্কার কাব্যতত্ত¡কেও আচ্ছন্নকরে ফেলেছিল। অলঙ্কার সেখানে কবিতার শরীরী প্রসঙ্গে পরিণত হয়েছে। পরবর্তী-সময়ে মানুষের জ্ঞানের বিস্তার, অনুভ‚তির তীক্ষ তা এর মনোজাগতিক সূ²তা অলঙ্কারকে কবিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেছে।

কাব্যপাঠকালে তার দুটি দিক আমাদেরকে প্রথম আকর্ষণ করে: এক. কাব্যে ব্যবহৃত পদের শব্দ বা ধ্বনি; দুই. তার অর্থ বা Meaning। শব্দ বা ধ্বনি গ্রহণ করি শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে আর অর্থ উপলব্ধি করি মন, অনুভ‚তি বা বোধ দিয়ে। ফলে, কাব্যের দুটি রূপ প্রকাশ পায়। প্রথমটি বর্ণময় অবয়ব (Concrete) আর অন্যটি অর্থময় চিদ্রূপ (Abstract)। এই রূপগত বিভাজনের ফলেই অলঙ্কার দুই রকমের:

এক. শব্দালঙ্কার

দুই. অর্থালঙ্কার

শব্দালঙ্কারের নিয়ন্তা হলো শব্দ বা ধ্বনি (ঝড়ঁহফ)। এই ধ্বনি কখনো পদধ্বনি, কখনো বর্ণধ্বনি আবার কখনো বাক্যধ্বনি। শব্দালঙ্কার প্রধানত কবিতার শরীরী ভ‚ষণকে রূপ দেয়। এই অলঙ্কারের মধ্যে অনুপ্রাস, যমক, শেষ, বক্রোক্তি প্রভৃতি প্রধান। অর্থালঙ্কারে শব্দ বা ধ্বনির পরিবর্তে অর্থেরই প্রাধান্য পায়। কবিতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, গভীরতা ও ব্যঞ্জনা অর্থালঙ্কারেই নিহিত। অর্থালঙ্কারের পরিধি ব্যাপক। এগুলোর মধ্যে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, সমাসক্তি, অন্যাসক্তি, বিরোধাভাষ, ব্যাজস্তুতি প্রভৃতি উলেখযোগ্য। যে অলঙ্কারকে আমরা কবিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেছি, তা আসলে অর্থালঙ্কারের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই ঘটেছে। কবিতার অন্তর্হিত চেতনাকে ব্যঞ্জনাময় ও চিরন্তনতা দানের প্রয়োজনে অর্থালঙ্কারের ভ‚মিকাই মুখ্য। 


চিত্রকল্প বা Image কবিতার জন্য অলঙ্কারেরও অধিক। কবির কল্পলোক উপমান এবং উপমেয়ের নিবস্তুকতায় যে মোহনীয় শব্দচিত্র সৃষ্টি করে, তারই তুঙ্গতম পর্যায়ে চিত্রকল্পের জন্মক্স। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বলাকা’ কবিতার একটি অংশ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে:

মনে হল, এ পাখার বাণী

দিল আনি

শুধু পলকের তরে

পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে

বেগের আবেগ।

পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;

উদ্ধৃতাংশে শব্দ, ধ্বনি এবং চিত্র কল্পনার অন্তর্ময় প্রয়োগে যে নিবর্স্তুক (Abstract) ব্যঞ্জনা লাভ করেছে, তার ব্যাখ্যা অলঙ্কারের সূত্র দিতে পারলেও এর অর্থময়তা অনুভ‚তির গভীরতা দিয়েই অনুধাবন করতে হবে।

ছন্দ - কবিতার রূপবিচারের ক্ষেত্রে ছন্দ চিরকালই স্বীকৃত ও চর্চিত হয়েছে। কেননা, কবিতার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণউপাদান হলো ছন্দ। একমাত্র কাব্যধর্মীনাটক ছাড়া সাহিত্যের অন্যসব রূপ (Form) থেকে কবিতাকে পৃথক করে এই ছন্দ। সাধারণভাবে ছন্দ (Meter) এবং ছন্দস্পন্দ (Rhythm)-কে আলাদাভাবে দেখানো হলেও সার্থক কবিতার ছন্দ গড়ে ওঠে দুটিরই আশ্রয়ে। ছন্দস্পন্দের সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনিরূপতি রূপই হলো ছন্দ।

বাংলা কবিতায় তিন ধরনের ছন্দের প্রচলন স্বীকৃত:

১. অক্ষরবৃত্ত

২. মাত্রাবৃত্ত

৩. স্বরবৃত্ত

যুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষরের মাত্রাবৈচিত্র্য এবং ঝোঁক (Stress)-এর প্রবণতা অনুযায়ী ছন্দের এই শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। কিন্তু ছন্দবিচারে এগুলোই শেষ কথা নয়। কবিতায় অর্থ ও ধ্বনির মেলবন্ধনে গভীরতর ব্যঞ্জনা সৃষ্টির জন্য ছন্দের প্রয়োগকে অনিবার্য হতে হয়। আধুনিক কবিরা জীবনের পরিবর্তন ধর্মকে কবিতায় রূপদান করতে গিয়ে ছন্দ নিয়ে বিচিত্র পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। ছন্দ হয়ে উঠেছে কবিতায় বিধৃত চেতনার অনিবার্য রূপকলা।

বস্তুসংক্ষেপ ঃ

আবেগ, অনুভ‚তি, স্বপ্ন, কল্পনা প্রভৃতি ব্যক্তিমানসের সাধারণ প্রবণতার অংশ; এগুলোর সঙ্গে যখন সৃষ্টিশীলতা যুক্ত হয়, অনিবার্য শব্দের তাৎপর্যময় বিন্যাস তাকে করে তোলে ব্যঞ্জনাময়। তখনই একটি কবিতার জন্মক্স সম্ভব। সাধারণভাবে বলা যায়, কবির স্বতঃস্ফ‚র্ত অনুভ‚তি শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে জীবনের অন্তর্ময় এবং স্থায়ী আবেদন সৃষ্টির উপযোগী যে শব্দসৌধ সৃষ্টি করে, তাই কবিতা।

কবিতার প্রকরণ বা শিল্পরূপ অনুধাবনের জন্য অলঙ্কার, চিত্রকলা, ছন্দ এবং ছন্দস্পন্দ সম্পর্কেধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। অলঙ্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ[অলম-কৃ(করা)+ঘঞ্ণ] আভরণ বা ভ‚ষণ। অর্থাৎ যে সকল উপাদান কবিতার অবয়বকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে সাধারণ অর্থেতাই অলঙ্কার। কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দ চিরকালই স্বীকৃত ও চর্চিত হয়েছে। কেননা, কবিতার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণউপাদান হল ছন্দ। কবিতার ছন্দ হয়ে উঠেছে বিধৃত চেতনার অনিবার্য রূপকলা।


পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন

১. কবিতা বলতে আমরা কি বুঝি ?

২. কবিতার বিভিন্ন শ্রেণীর পরিচয় দিন।

৩. মহাকাব্য কয় প্রকার ও কি কি?

৪. গীতিকবিতার রূপবৈচিত্র্যের পরিচয় দিন।

৫. বাংলা কবিতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখুন।

৬. অলঙ্কার কাকে বলে? সংক্ষেপে লিখুন।

৭. বাংলা ছন্দ কয় প্রকার ও কি কি?

রচনামূলক প্রশ্ন

১. কবিতার ক্ষেত্রে অলঙ্কারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করুন।

১ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর:

কবিতার সংজ্ঞার্থ নির্ণয় সহজ কাজ নয়। তবুও মনে রাখতে হবে সাহিত্যের সব শাখারই একটি মৌলিক মানদন্ড আছে যার ভিত্তিতে সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা সম্ভব। কবির বিশেষ অনুভ‚তি প্রকাশের জন্য শব্দের তাৎপর্যময় ও অনিবার্য বিন্যাস থেকে কবিতার সৃষ্টি। আরো ব্যাখ্যা করে বলতে গেলে আমরা বলতে পারি, আবেগ, অনুভ‚তি, স্বপ্ন কল্পনা প্রভৃতি ব্যক্তিমানুষের সাধারণ প্রবণতা। এগুলোর সঙ্গে কবির সৃজনশীলতা যুক্ত হয়ে কবিতার জন্ম হয়। 

Post a Comment

1 Comments