উপন্যাস
উদ্দেশ্য
এই পাঠ শেষে আপনি
উপন্যাস কাকে বলে সে বিষয়ে লিখতে পারবেন।
উপন্যাসের গঠনকৌশলের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কেধারণা ব্যক্ত করতে পারবেন।
উপন্যাসের রূপগত বৈচিত্র্য নির্দেশ করতে পারবেন।
সংজ্ঞার্থ
সাহিত্যের আঙ্গিকগুলোর মধ্যে উপন্যাসের সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ই বোধ হয় সর্বাপেক্ষা দুরূহ কাজ। কেননা, সময় ও সমাজের এতো বিচিত্রমুখী ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন ও ভাঙা-গড়ার যুগে উপন্যাসের আবির্ভাব হয়েছে যে, নির্দিষ্ট কোনো মানদন্ড দিয়ে উপন্যাসের স্বভাবধর্ম নিরূপন করা সম্ভব নয়। উপন্যাসের উদ্ভবের সঙ্গে সমাজবিন্যাস, আর্থ-উৎপাদন কাঠামো, মানুষের মনোজাগতিক সূ²তা এবং অস্তিত্বজিজ্ঞাসার জটিল ক্রমবিকাশের প্রশ্নজড়িত। রেনেসাঁ বা নবজাগরণপরবর্তীমানুষের নতুন জীবন - ভাবনা, বাণিজ্যপুঁজির আশ্রয়ে গড়ে-ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিপুল বিস্তার এবং শিল্পবিপ্লবউত্তর নাগরিক সভ্যতার দ্ব›দ্বসংঘাতপূর্ণ, জটিল, বৈচিত্র্যময় ও গতিশীল জীবনের শিল্প-আঙ্গিক হিসেবে ইউরোপে উপন্যাসের উদ্ভব। সুতরাং উপন্যাস তার জন্মলগ্নেই সমাজ ও জীবনের বাস্তবতার অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে। এই বাস্তবতার চরিত্র সমাজ ও ব্যক্তিভেদে বিচিত্র।
উপন্যাসের সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ে, তার বিষয় ও আঙ্গিকের স্বরূপ নির্ধারণে আলোচনার শেষ নেই। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সমালোচকগণ দীর্ঘকাল ধরে বিতর্ক ও বিশেষণে আত্মনিয়োগ করেছেন, কিন্তু কোনো মীমাংসিত সিদ্ধান্তেতাঁরা উপনীত হতে পারেন নি। তবুও স্বভাবলক্ষণ এবং বিষয় ও আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্য বিচার করে উপন্যাসের সংজ্ঞার্থনির্ধারণ করা সম্ভব।
এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, উপন্যাসের সংজ্ঞার্থ নির্ণয় ও বিষয়-আঙ্গিক বিচার সময় ও সমাজের চরিত্র ও রুচি অনুসারী। যেমন আয়তন, চরিত্র এবং ঘটনা-বৈশিষ্ট্য বিচারে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’ এবং লিউ তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পীস’ দুই ভিন্ন স্বভাবের সৃষ্টি হওয়া সত্তে¡ও উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। হারমান মেলাভিলের ‘মবিডিক’ এবং জেমস্ জয়েসের ‘ইউলিসিস’, কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুন্ডলা’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্র ‘চাঁদের অমাবস্যা’, এবং শহীদুলা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ আয়তন, চরিত্রায়ন এবং বিষয়বিচারে ভিন্নধর্মী সৃষ্টি। কিন্তু সবগুলোই উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত ও বিশেষিত। তবুও উক্ত গ্রন্থগুলোতে মোৗলিক কিছু লক্ষণ বিদ্যমান, যার ভিত্তিতে ঐসব গ্রন্থ উপন্যাসের পর্যায়ভুক্ত।
উপর্যুক্ত ধারণার আলোকে উপন্যাসের একটি সাধারণ সংজ্ঞার্থ আমরা নির্ণয় করতে পারি। তাহলো, যে বর্ণনাত্মক রচনায় মানুষের বাস্তব জীবনকথা লেখকের জীবনসম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অভিব্যক্ত হয়, তাকেই উপন্যাস বলে। ঘটনামূলক ও বর্ণনাধর্মী হওয়ায় গদ্যভাষাই উপন্যাসের প্রকাশবাহন। মানুষের জীবন জটিল, সূ² এবং বিচিত্র। জীবনবৈশিষ্ট্যের বহুমুখী রূপের প্রতিফলন ঘটায় প্রতিটি উপন্যাসের আয়তন ভিন্নধর্মী। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ এবং ‘শেষের কবিতা’ বিচার করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, উপন্যাস কেবল কাহিনী কিংবা ঘটনামাত্র নয়। মানুষের জীবনে অসংখ্য ঘটনা ঘটে। কোনো ঘটনা যৌক্তিক শৃঙ্খলাযুক্ত আবার কোনোটার মধ্যে তা থাকেনা। এজন্যেই উপন্যাসবিধৃত ঘটনাংশের মধ্যে যৌক্তিক শৃঙ্খলা থাকতে হবে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, চরিত্র ও ঘটনার সমন্বয়ে একটি উপন্যাস হয়ে উঠবে যথার্থ।
উপন্যাসের উপাদান ও গঠনকৌশল
উপন্যাসের উপাদানের সংখ্যা ৭। এর মধ্যে শরীরী উপাদানের (Concrete elements) সংখ্যা-৬। যেমন, প্লট (plot), চরিত্র (Character), দৃষ্টিকোণ (Point of view), পশ্চাৎপট (Back ground), সময় (Time), এবং ভাষা (Language)। উপন্যাস বিশেষণে অশরীরী উপাদান (Abstruct elements) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে লেখকের জীবন সম্পর্কিত দর্শনকে।
প্লট
ইংরেজি সাহিত্যে উপন্যাস রচনার প্রথম দিকে গ্রীক সাহিত্যতাত্তি¡ক ও সমালোচক অ্যারিস্টটলের প্লটসম্পর্কিত ধারণার প্রভাবই ছিলো সর্বাধিক। অ্যারিস্টটল তাঁর Poetics গ্রন্থে প্লটের আলোচনায় বলেছেন একটি মাত্র কর্মের সমগ্র রূপ অনুকৃত হয় প্লটে। বিভিন্ন অংশের মধ্যে গঠনগত ঐক্য এমনভাবে অক্ষুণœ রাখার চেষ্টা করা হয়, যার ফলে একটি অংশকে তার ভেতর থেকে স্থানান্তরিত করলে প্লটের সমগ্র গঠনটিই ভেঙে পড়বে (So the plot being an imitation of an action, must imitate one action and that a whole, the structural vision of the parts being such that, if any one of them in displaced or removed, the whole will be disjoined and disturbed)। অ্যারিস্টটলের মতে প্লট একটি সমগ্র ও সম্পর্ক‘কর্ম’ (Action), অন্যত্র তিনি বলেছেন, প্লট হচ্ছে ঘটনাবলীর বিন্যাস (Arrangement of incidents) এবং এই ঘটনাবিন্যাসে আদি, মধ্য এবং অন্তের মধ্যে থাকবে ঐক্য। তিনি প্লটকে সরল (Simple) ও জটিল (Complex) এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছিলেন। তাঁর জটিল প্লটের ধারণা প্লটভাবনার পরবর্তী রূপান্তরের সম্ভাবনার পথ প্রশস্তকরেছিলো।
আজকের বিচারে হয়তো অ্যারিস্টটলের ধারণার মধ্যে অপূর্ণতা লক্ষ করা যাবে, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্তএই ধারণাকেই উপন্যাসের তাত্তি¡ক এবং তত্ত¡চেতন ঔপনাসিকরা বহুলাংশে গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম যুগের ঔপন্যাসিকরা যেমন, রিচার্ডসন এবং হেনরি ফিলডিং চষড়ঃ এবং ঝঃড়ৎু (কাহিনী)-কে অভিন্ন অর্থে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা কাহিনীকে একটি ঐক্যবদ্ধ রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্লট ধারণারও পরিবর্তন ঘটে। উপন্যাসবিধৃত কর্ম বা অপঃরড়হ যে মানব চরিত্রের রূপায়ণ এ-সত্যটি সুস্পষ্ট হতে থাকে। ঘটনা, চরিত্র, চরিত্রের চিন্তা, অনুভ‚তি, তার জীবনসম্পর্কিত তত্ত¡ বা দর্শনও গুরুত্বপূর্ণহয়ে ওঠে। হেনরি জেমস তাঁর The Art of Fiction (১৮৮৪) প্রবন্ধে প্লট এবং কাহিনীর সঙ্গে উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সাদৃশ্য সন্ধান করেছেন। বিংশ শতাব্দীতে এসে উপন্যাসের প্লটভাবনায় সময়ের গুরুত্বস্বীকৃত হলো। মানবজীবনে সংঘটিত ঘটনা যে আসলে সময়েরই বহিঃপ্রকাশ এই বোধ থেকে প্লটকে বলা হলো কার্যকারণ শৃঙ্খলাযুক্ত সময়। এই সময়ের বহমানতা বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক রকম আর চিন্তা, অনুভ‚তি, স্মৃতি-স্বপ্ন-কল্পনার মানদন্ডে এক রকম। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রচট্টোপাধ্যায় প্লটকে ঘটনার পারম্পর্যহিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাস প্লটবিন্যাসের নির্ভুল দৃষ্টান্ত। ঐতিহাসিক ঘটনার রূপায়নেও ‘রাজসিংহ’ কিংবা ‘আনন্দমঠ’-এ প্লটবিন্যাসের প্রচলিত রীতির অনুসারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম প্লটকে সময় ও চেতনার ঐক্যে সুগ্রথিত করলেন। তাঁর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের প্লট কাহিনী (Story) কিংবা ‘ঘটনা’র (Events) পারম্পর্য শৃঙ্খলাযুক্ত বিন্যাসমাত্র নয়, আধুনিক শিক্ষিত মানব-মানবীর চেতনা, অনুভ‚তি, কল্পনা ও দর্শনের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমও ঘটে।
চরিত্র
উপন্যাসের শরীরী উপাদানসমূহের মধ্যে চরিত্রের গুরুত্ব সর্বাধিক। কেননা, উপন্যাস মানুষের সৃষ্টি এবং অন্তর-বাহির সমেত মানব-মানবীর সমগ্রজীবনের রূপায়ণের প্রয়োজনবোধই উপন্যাসের জন্মকে সম্ভব করে তুলেছিলো। অ্যারিস্টটল চরিত্র অপেক্ষা প্লটকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ট্র্যাজেডির গঠনবৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ছয়টি অংশ প্রত্যক্ষ করেছেন। যেমন, প্লট, চরিত্র , ভাষা, ভাবনা (Thought), দৃশ্য এবং সঙ্গীত। প্রথমে তিনি প্লটের আলোচনা করেছেন। অতঃপর চরিত্রের । কিন্তু পট যে জীবনের কাজের অনুকরণ, তা নিঃসন্দেহে মানুষের। অভিজ্ঞতা এবং দৃষ্টান্তের সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও অ্যারিস্টটল চরিত্রের প্রকৃত ক্ষেত্রটি নির্দেশ করতে পেরেছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিকরা পুক্সক্ষানুপুঙ্খ বর্ণনাকে (Narration) অধিক গুরুত্বদিতেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের অনেক উপন্যাসেও বর্ণনাবাহুল্য চোখে পড়ে। কিন্তুবর্ণনার মধ্য দিয়ে চরিত্রের বাইরের অবয়ব, গতিবিধি, দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলিই উপস্থাপন করা যায়। চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনের জন্যে বর্ণনার অতিরিক্ত আরো কিছু প্রয়োজন। জর্জ মেরিডিথ এই ভাবনা থেকেই সম্ভবত বলেছিলেন: ‘কেবল চোখের পাতায় রঙ দিলেই চলবে না, চোখের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টিও ফোটাতে হবে।’ ফরাসি বিপ্লব ও শিল্প-বিপ্লবোত্তর কালে মানুষের ব্যক্তিসত্তার গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসেও চরিত্রের অবস্থান দৃঢ়তর হতে থাকে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে চরিত্রের রূপায়ণ মূলত বর্ণনাধর্মী। চরিত্রের ক্রিয়াশীলতা সমাজ, উপন্যাসবিধৃত ঘটনা এবং ঔপন্যাসিকের আদর্শবোধের কাছে দায়বদ্ধ। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসে আয়েষা চরিত্র সম্পর্কেলেখকের উক্তি: ‘যেমন উদ্যান মধ্যে পদ্মফুল, এ আখ্যায়িকা মধ্যে তেমনি আয়েষা।’ অর্থাৎ পুরো উপন্যাসে আয়েষা ঘটনার প্রয়োজনে উপস্থাপিত। আপন ব্যক্তিত্ত¡ ও কর্মধারায় সে স্বাবলম্বী নয়। ই.এম. ফরস্টার এ-ধরনের চরিত্রকে বলেছেন Flat Character বা সমতল চরিত্র। এ-ধরনের চরিত্র উপন্যাসের ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। ঘটনাধারার সঙ্গে অক্রিয় (Passive) অবস্থান করে মাত্র। কিন্তু যে চরিত্র উপন্যাসের শুরু থেকেই আকৃতি-প্রকৃতিসহ উপস্থাপিত হয় এবং তার ভবিষ্যৎ গতিবিধি, প্রাধান্য, মনোজাগতিক পরিবর্তন ও বিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতসহ ক্রিয়াশীল থাকে, তাকে বলা হয় Round Character বা নিটোল চরিত্র। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ বিনোদিনী চরিত্রকে গোড়া থেকেই তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা চিত্রিত করেছেন। ফলে, চরিত্রটি হয়ে উঠেছে সমগ্র।
‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের চরিত্রায়নকে এ-প্রসঙ্গে দৃষ্টান্তহিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। শচীশ, জগমোহন, দামিনী এবং শ্রীবিলাস এই চারটি চরিত্রের রূপায়ণে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন। শ্রীবিলাস সমতল চরিত্র (Flat Character)। তার চরিত্রের বিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত উপন্যাসে নেই আগাগোড়া একই রকম। তার মানসিক পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত বা প্রাসঙ্গিকতা উপন্যাসে নেই। শচীশ এবং দামিনীর স্বভাবধর্ম ও বিবর্তনের ইঙ্গিত গোড়া থেকেই সুস্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসের চরিত্রায়নে এই পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে। ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী, ‘গোরা’ উপন্যাসের গোরা, ‘যোগাযোগে’র কুমুদিনী, ‘শেষের কবিতা’র অমিত ও লাবণ্য তী² রেখায় চিত্রিত এবং ব্যঞ্জনাগর্ভ।
‘চতুরঙ্গে’ শচীশ সম্পর্কেরবীন্দ্রনাথের ভাষ্য চরিত্রটির সমগ্র স্বরূপ উন্মোচন করে। যেমন, ‘শচীশ দেখিলে মনে হয় যেন একটা জ্যোতিষ্ক তার চোখে জ্বলিতেছে। তার সরু সরু লম্বা আঙুলগুলি যেন আগুনের শিখা, তার গায়ের রং যেন রং নহে, তা আভা। শচীশকে যখন দেখিলাম অমনি যেন তার অন্তরাত্মাকে দেখিলাম।’ দামিনী সম্পর্কেলেখকের দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন। যেমন, ‘দামিনী যেন শ্রাবণ মেঘের ভিতরকার কামিনী’। বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ, অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিকমিক করিয়া উঠিতেছে।’ শচীশ এবং দামিনীর বহিরাবয়বের সঙ্গে তাদের অন্তরজগৎও এভাবে উন্মোচিত হয়েছে। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে অমিত রায় এবং লাবণ্য চরিত্রের রূপ, স্বরূপ এবং পরিণতি সূ² ইঙ্গিতে রেখায়িত করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
১. অমিতর নেশাই হল স্টাইলে। কেবল সাহিত্য-বাছাই কাজে নয়, বেশে ভ‚ষায় ব্যবহারে। ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাঁদ আছে। পাঁচজনের মধ্যে এ যে-কোনো একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম। ... দাঁড়িগোফ-কামানো চাঁচা মাজা চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ, স্ফ‚র্তি ভরা ভাবটা, চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি হয় না; মনটা এমন এক রকমের চকমকি যে ঠুন করে একটু ঠুকলেই স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ে।
২. বাপের একমাত্র শখ ছিল বিদ্যায়, মেয়েটির মধ্যে তাঁর সেই শখটির সম্পূর্ণপরিতৃপ্তি হয়েছিল। নিজের লাইব্রেরির চেয়েও তাকে ভালোবাসতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, জ্ঞানের চর্চায় যার মনটা নিরেট হয়ে ওঠে সেখানে উড়ো ভাবনার গ্যাস নিচে থেকে ঠেলে ওঠার মতো সমস্তফাটল মরে যায়। সে মানুষের পক্ষে বিয়ে করবার দরকার হয় না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে তাঁর মেয়ের মনে স্বামীসেবা-আবাদের যোগ্য যে নরম জমিটুকু বাকি থাকতে পারত সেটা গণিতে ইতিহাসে সিমেন্ট করে গাঁথা হয়েছে খুব মজবুত পাকা মন যাকে বলা যেতে পারে বাইরে থেকে আঁচর লাগলে দাগ পড়ে না। উপন্যাসে চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির বহুল পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু জীবনের যে কোনো সত্যের উন্মোচনে চরিত্রের অনিবার্যতা অক্ষুন্নই রয়ে গেছে।
উপন্যাসের দৃষ্টিকোণ (Point of view)
বিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য উপন্যাসতাত্তি¡কদের মতে দৃষ্টিকোণই হলো উপন্যাসের সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপাদান। ঘটনাংশ, চরিত্র কিংবা অন্যান্য উপাদানের উপস্থাপন কৌশল নির্ভর করে দৃষ্টিকোণের ওপর। ঔপন্যাসিকের জীবনকে দেখা এবং দেখানোর পদ্ধতি দৃষ্টিকোণই নির্ধারণ করে দেয়। উপন্যাস রচনার প্রথম পর্যায়ে ঘটনার যে বর্ণনাত্মক (Narrative) উপস্থাপন লক্ষ করি, সেখানে সমস্তঘটনা, চরিত্রের গতিপ্রকৃতি ও আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গ লেখক স্বয়ং বিধৃত করতেন। অতঃপর উপন্যাসে মানবচরিত্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পর প্রধানত কেন্দ্রীয় চরিত্রের দৃষ্টিকোণের প্রয়োগ ঘটতে থাকে। স্মৃতিমূলক কিংবা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে মুখ্য-চরিত্র নিজেই নিজের কথা বিধৃত করে। সমগ্রঘটনার ওপর লেখকের দৃষ্টির একক নিয়ন্ত্রণ কিংবা মুখ্য চরিত্রের দৃষ্টিকোণ ছাড়াও তৃতীয় কোন চরিত্রও ঘটনা বর্ণনা করতে পারে উপন্যাসে।
উপন্যাসবিধৃত ঘটনা যখন লেখক নিরাসক্তভাবে প্রত্যক্ষ করে বিবৃত করেন, তখন বলা হয় লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ (Author`s Omnscient point of view)। মুখ্য চরিত্র কিংবা নায়কের জবানিতে যখন ঘটনা বিবৃত হয়, তখন তাকে অভিহিত করা হয় উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণ হিসেবে (First person`s point of view)। ঘটনার প্রান্তেঅবস্থানকারী কোনো চরিত্রের দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হলে বলা হয়, প্রান্তিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ (Peripherid character)। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের একজন প্রখ্যাত উপন্যাসতত্ত¡বিদ পার্সি লুবক তাঁর Craft of Fiction (1921) গ্রন্থে দৃষ্টিকোণের অনিবার্যতা প্রথম সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করলেন। তাঁর মতে, উপন্যাসশিল্পের যাত্রা সেদিন থেকেই কার্যকরভাবে সূচিত হলো, যেদিন ঔপন্যাসিক ভাবতে আরম্ভ করলেন যে, ‘তাঁর গল্প এমন একটি বিষয় যাকে ঘটমান অবস্থায় দেখাতে হবে এবং এমনভাবে দেখাতে হবে যেন গল্পটি নিজেই নিজের কথা বলছে। অর্থাৎ ঔপন্যাসিক নিজে গল্পটির বিবরণ দিলে সেটা উপন্যাসের সার্থক শিত্মকলা হল না। ঘটনাবলি এবং চরিত্রগুলা যেন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়ে নিজেদের কথা বলে ও কাজও করে গল্পটিকে ফুটিয়ে তুলবে। বলা (Telling) নয়, দেখানোই (Showing) হলো উপন্যাসের নিজস্ব শিল্পরীতি।’ লুবকের মতে দৃষ্টিকোণই হলো উপন্যাসের শিল্পরীতির সবচেয়ে জটিল বিষয়। পার্সি লুবকের পরে ই.এম.ফরস্টার, জে. ডবিউ. বীচ, মার্ক স্কোরার, নরম্যান ফ্রায়াডম্যান প্রমুখ উপন্যাসতত্ত¡বিদ দৃষ্টিকোণের তাৎপর্যকে উপন্যাসবিচারের কেন্দ্রে স্থাপন করলেন।
কোনো উপন্যাস গভীরভাবে অনুধাবন করতে গেলে লেখকের দৃষ্টিকোণের স্বরূপ বুঝতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একমাত্র ‘রজনী’ ছাড়া সকল উপন্যাসই সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিধৃত হয়েছে। রজনী’তে মুখ্য-চরিত্রের দৃষ্টিকোণের প্রয়োগ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। তাঁর ‘চোখের বালি’ এবং ‘গোরা’ সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে একাধিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশ, সন্দীপ এবং বিমলার দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের ফলে উপন্যাসশিল্পে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। ‘শেষের কবিতা’য় লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হলেও চরিত্রসমূহের (বিশেষ করে অমিত ও লাবণ্য) অন্তর্লোক উন্মোচনের প্রয়োজনে তাদের দৃষ্টিকোণকেও গুরুত্বদেওয়া হয়েছে।
রবীন্দ্র পরবর্তীকালে দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। দৃষ্টিকোণ প্রয়োগের কৌশল উপন্যাস বিচারে অন্যতম প্রধান মানদন্ডে পরিণত হয়েছে।
পশ্চাৎপট (Background)
উপন্যাসবিধৃত প্রতিটি ঘটনা এবং চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার একটি স্থান বা পটভ‚মিগত ভিত্তি থাকে। কোনো ঘটনা কিংবা কাজ নিরবলম্ব বা শূন্য থেকে ঘটে না। এজন্যেই ঘটনা বা বিষয়ের একটি পশ্চাৎপট অনিবার্য হয়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে উইলিয়াম থ্যাকারে, চার্লস ডিকেন্স, জর্জ এলিয়ট পশ্চাৎপটকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করলেন। ডিকেন্স চরিত্র ও ঘটনার প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থান বা পশ্চাৎপটের বর্ণনা দিয়েছেন। জর্জএলিয়টের কাছে পশ্চাৎপটের উপস্থিতি চরিত্র অঙ্কনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
বিংশ শতাব্দীতে এই ধারণাটির ব্যাপক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কেউ কেউ পশ্চাৎপটকে স্বতন্ত্রভাবে মূল্য দিতে চেয়েছেন। কিন্তু উপন্যাসের অন্য সব উপাদানের সঙ্গে সমন্বিত হয়েই পশ্চাৎপট বা স্থানের সার্থকতা। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের স্থান বা পশ্চাৎপট নাগরিক কোলাহল থেকে দূরবর্তী। উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও চরিত্রগুলোর অন্তর্জগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপস্থাপনে শিলং পাহাড়ের নির্জন পরিবেশের ভ‚মিকাকে রবীন্দ্রনাথ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন।
সময়
অ্যারিস্টটল তাঁর Poetics গ্রন্থে ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যায় যে ত্রি-ঐক্যনীতির কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে কালের বা সময়ের ঐক্যের কথাও ছিলো। তবে তাঁর কাছে ক্রিয়াগত ঐক্যই (Unity of action) সর্বাধিক গুরুত্বপেয়েছিলো। তার পরে এসেছে স্থান (Unity of place) ও কালগত ঐক্যের i (Unity of time) প্রসঙ্গ। উপন্যাস রচনার প্রথম যুগ থেকেই সময়ের তাৎপর্য লেখকের কাছে গুরুত্বপেয়েছে। স্যামুয়েল রিচার্ডসন ‘ক্লারিসা’ উপন্যাসে পত্রলিখন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে গিয়ে সময়ের ক্রমধারাকে সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করেছেন। হেনরি ফিল্ডিং-এর ‘টম জোনস’ উপন্যাসেও সময়ের ক্রম অনুসৃত হয়েছে। কিন্তু এঁরা সময়কে উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণউপাদান মনে করেননি। ঘটনাক্রম রক্ষার ক্ষেত্রে সময়কে অনুসরণ করেছেন মাত্র। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধব্যাপী উপন্যাসে সময়ের তাৎপর্য সচেতনভাবে স্বীকৃত হয়নি। হেনরি জেমসই প্রথম সময়কে উপন্যাসের গঠনগত ঐক্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণউপাদান হিসেবে গ্রহণ করেন। বালজাকের উপন্যাস আলোচনায় তিনি সময় রহস্যের স্বরূপ সন্ধান করেছেন। তিনি দুটি প্রসঙ্গে সময়ের গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন :
১. চরিত্র ও ঘটনাবলির সংক্ষেপীকরণের রহস্য ;
২. উপন্যাসের বিষয়বস্তুর স্থিতিকাল ও অতিক্রান্তসময়ের প্রকাশ।
উপন্যাসে সময় নামক উপাদানকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে সময়ের ক্রিয়াশীলতাকে অনিবার্যতা দান করা তাঁর মতে অত্যন্ততাৎপর্যপূর্ণ। তিনি সময়রূপ উপাদানকে উপন্যাসের সাংগঠনিক ঐক্যসৃষ্টির (Organic Unity) কাজে ব্যবহৃত দেখতে চেয়েছেন। বিংশ শতাব্দীতেই প্রকৃতপক্ষে সময়ের প্রাসঙ্গিকতা উপন্যাসে গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত হয়। প্রূস্ত, ডরোথি রিচার্ডসন ও জেমস জয়েসের মতো ঔপন্যাসিকরা সময়ধারণাকে উপন্যাসতত্তে¡র কেন্দ্রেস্থাপন করলেন।
- সামাজিক উপন্যাস
- ঐতিহাসিক উপন্যাস
- পৌরাণিক উপন্যাস
- আঞ্চলিক উপন্যাস
- আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস
- ক. কাব্যধর্মী উপন্যাস
- খ. ভ্রমণ উপন্যাস
- গ. পত্রোপন্যাস
- ঘ. মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাস
- ঙ. চেতনাপ্রবাহরীতির উপন্যাস
- চ.রহস্য উপন্যাস
- ছ. প্রতীকী উপন্যাস
- জ. মহাকাব্যিক উপন্যাস ইত্যাদি।
0 Comments