সেকালে আরব দেশে তিনটি লোক ছিল-_ একজনের সর্বাঙ্গে ধবল, একজনের মাথায় টাক, আরেকজনের দুই চোখ অন্ধ | আল্লাহ্ তাহাদের পরীক্ষার জন্য এক ফেরেশতা পঠাইলেন। ফেরেশতা হইলেন আল্লাহর দূত। তাহারা নূরের তৈয়ারী। এমনি কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পায় না। আল্লাহ্র হুকুমে তাহারা সকল কাজ করিয়া থাকেন।
ফেরেশতা মানুষের রূপ ধরিয়া প্রথমে ধরলরোগীর নিকটে আসিলেন। ভিনি তাহাকে বলিদেন, কী তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো।
ধরলরোগী বলিল, আহা। আমার গায়ের রং যদি ভােলো হয়। সকলে যে আমাকে বন্ধ যৃণা করে। স্বীয় দূত তাহার গায়ে হাত বুলইিয়া দিলেন। তাহার রোগ সারিয়া গেল । তাহার গায়ের চামড়া ভালো হইল। তারপর আল্লাহ্র দূত পুনরায় তাহাকে জিজ্জাসা করিলেল, এখন তুমি কী চাও?
সে বলিল, আমি 'উট চাই ।
দূত তাহাকে একটি গাভিন উট দিয়া বলিলেন, এই লও । ইহাতে তোমার ভাগ্য খুলিবে।
তারপর দেই ফেরেশতা টাকওয়ালার কাছে গিয়া বলিলেন, কী তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো ?
লে বলিল, আহা! আমার এই রোগ যদি সারিয়া যায়। যদি আমার মাথায় চুল উঠে!
আল্লাহর দূত তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিলেন । তাহার টাক সারিয়া গেল । তাহার মাথায় চুল গজাইল । দূত পুনরায় বলিলেন, এখন তুমি কী চাও?
সে বলিল, গাভি।
তিনি তাহাকে একটি গাভিন গাই দিয়া বলিলেন, এই লও। ইহাতে তোমার ভাগ্য খুলিবে। তারপর সর্গীয় দূত অন্ধের কাছে গেলেন । গিয়া বলিলেন, কী ভুমি সবচেয়ে ভালোবাসা?
সে বলিল, আল্লাহু আমার চোখ ভালো করিয়া দিন। আমি যেন লোকের মুখ দেখিতে পাই।
স্বর্গীয় দূত ভাহার চোখে হাত বুলাইয়া দিলেন। "তাহার চোখ ভালো হইয়া গেল।
তারপর তিনি তাহাকে বলিলেন, এখন তুমি কী চাও?
সে বলিল, আমি ছাগল চাই ।
স্বীয় দূত তাহাকে একটি গাভিন ছাগল দিয়া বলিলেন, এই লও । ইহাতে তোমার ভাগ্য খুলিবে। তারপর উটের বাচ্চা হইল, গাভির বাছুর হইল, ছাগলের ছানা হইল । এই রকম করিয়া উটে, গাভিতে, ছাগলে তাহাদের মাঠ বোঝাই হইয়া গেল। কিছুদিন পর আবার সেই ফেরেশতা পূর্বের মতো মানুষের রূপ ধরিয়া, সেই যে আগের ধবলরোগী ছিল, তাহার নিকট উপস্থিত হইলেন।
সেখানে গিয়া তিনি বলিলেন, আমি এক বিদেশি। বিদেশে আসিয়া আমার সব পুঁজি ফুরাইয়া গিয়াছে। এখন আল্লাহর দয়া ছাড়া আমার আর দেশে ফিরিবার উপায় নাই। যিনি তোমারে সুন্দর গায়ের রং দিয়াছেন, সুন্দর চামড়া দিয়াছেন, আর এত ধনদৌলত দিয়াছেন, তাঁহার দোহাই দিয়া তোমার কাছে একটি উট চাহিতেছি।
সে বলিল, উটের অনেক দাম, কী করিয়া দিই?
স্বগীয় দূত বলিলেন, ওহে ! আমি যেন তোমাকে চিনিতে পারিতেছি। তুমি না ধবলরোগী ছিলে, আর সকলে তোমাকে ঘৃণা করিত? তুমি না গরিব ছিলে, পরে আল্লাহ তোমাকে ধনদৌলত দিয়াছেন? সে বলিল, না, তা কেন? এসব তো আমার বরাবরই আছে।
স্বগীয় দূত বলিলেন, আচ্ছা ! যদি তুমি মিথ্যা বলিয়া থাক, তবে তুমি যেমন ছিলে আল্লাহ আবার তোমাকে তাহাই করিবেন।
তারপর স্বগীয় দূত পূর্বে যে টাকওয়ালা ছিল, তাহার কাছে গেলেন। সেখানে গিয়া আগের মতো একটি গাভি চাহিলেন। সেও ধবলরোগীর মতো তাহাকে কিছুই দিল না। তখন স্বগীয় দূত বলিলেন, আচ্ছা, যদি তুমি মিথ্যা কথা বলিয়া থাক, তবে যেমন ছিলে আল্লাহ তোমাকে আবার তেমনি করিবেন।
তারপর স্বগীয় দূত পূর্বে যে অন্ধ ছিল, তাহার কাছে গিয়া বলিলেন, আমি এক বিদেশি । বিদেশে আমার সম্বল ফুরাইয়া গিয়াছে। এখন আল্লাহর দয়া ছাড়া আমার দেশে পৌঁছিবার আর কোনো উপায় নাই । যিনি তোমার চক্ষু ভালো করিয়া দিয়াছেন, আমি তোমাকে সেই আল্লাহর দোহাই দিয়া একটি ছাগল চাহিতেছিঃ যেন আমি সেই ছাগল-বেচা টাকা দিয়া দেশে ফিরিয়া যাইতে পারি।
তখন সে বলিল, হ্যাঁ ঠিক তো। আমি অন্ধ ছিলাম, পরে আল্লাহ আমাকে দেখিবার ক্ষমতা দিয়াছেন। আমি গরিব ছিলাম, তিনি আমাকে আমির করিয়াছেন। তুমি যাহা চাও লও। আল্লাহর কসম, আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে জিনিস লইতে তোমার মন চায়, তাহা যদি তুমি না লও, তবে আমি তোমাকে কিছুতেই ভালো লোক বলিব না।
ফেরেশতা তখন বলিলেন, বাস্। তোমার জিনিস তোমারই থাক । তোমাদের পরীক্ষা লওয়া হইল । আল্লাহ তোমার উপর খুশি হইয়াছেন, আর তাহাদের উপর বেজার হইয়াছেন।
শব্দার্থ ও টীকা
ধবল - সাদা। শ্বেত। এক প্রকার চর্মরোগ- এই রোগে শরীরে চামড়া ও চুল সাদা হয়ে যায়।
গাভিন - গর্ভধারণ করেছে এমন (গাভিন গরু)।
আমির - ধনী। ধনবান।
সর্বাঙ্গে _ সের্ব+অঙ্গ ৯ সর্বাঙ্গ+ এ বিভক্তি) সারা শরীরে । সমস্ত দেহে।
কসম _ শপথ। দিব্যি।
স্বগীয় দূত - আল্লাহর বার্তা বাহক। সংবাদবাহক।
নূর _ জ্যোতি। আলো।
পুঁজি - সম্বল। মূলধন।
দোহাই _ শপথ । কসম।
সম্বল _ পাথেয়। পুঁজি।
বেজার _ অখুশি। অসন্তুষ্ট ।
পাঠের উদ্দেশ্য - সততা, পরোপকার ও নৈতিক মূল্যবোধ অর্জন ।
পাঠ-পরিচিতি - সাধুরীতিতে রচিত এই গল্পে হাদিসের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই গল্পের মূল বাণী হচ্ছে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন এবং সঘলোককে যথাযথ পুরস্কার দেন। আরব দেশের তিন জন লোককে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠান। এদের একজন ধবলরোগী একজন টাকওয়ালা এবং আরেকজন অন্ধ । ফেরেশতার অনুগ্রহে এই তিন জনেরই শারীরিক ত্রুটি দূর হলো। তিন জনই সুন্দর সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের চেহারা পেল। শুধু তাই নয়, ফেরেশতার কৃপায় প্রথম জন একটি উট থেকে বহু উটের, দ্বিতীয় জন একটি গাভি থেকে বহু গাভির এবং তৃতীয় জন একটি ছাগল থেকে বহু ছাগলের মালিক হয়ে গেল। কিছুদিন পর এদের পরীক্ষা করার জন্য ফেরেশতা গরিব বিদেশির ছদ্মবেশে এদের কাছে হাজির হলেন। তিনি একেক জনের কাছে গিয়ে তাদের আগের দুরবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে কিছু সাহায্য করতে বললেন। প্রথম দুজন তাদের আগের অবস্থার কথা অস্বীকার করে ছদ্মবেশী ফেরেশতাকে খালি হাতে বিদায় দিল। অন্যদিকে তৃতীয় জন নির্ঘিধায় ফেরেশতার ইচ্ছেমতো সবকিছু দিতে রাজি হল। আল্লাহ তার উপর খুশি হলেন এবং তার সম্পদ তারই রয়ে গেল। প্রথম দুজনের উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাদের অবস্থা আগের মতো হয়ে গেল। অকৃতজ্ঞরা তাদের অকৃতজ্ঞতার উপযুক্ত ফল পেল।
লেখক-পরিচিতি - মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্য ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার পেয়ারা গ্রামে। তিনি বহুভাষাবিদ ও পত্তিত হিসেবে খ্যাত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯১০ সালে কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে বিএ অনার্স ও ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতক্কে এমএ পাস করেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত বিভাগের প্রথম ছাত্র। পরে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লিটারেচার ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় তিনি অসাধারণ পাগ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা ব্যাকরণ রচনাতেও তাঁর অবদান স্মরণীয়। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ছোটদের জন্য তাঁর লেখা রচনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- “শেষ নবীর সন্ধানে' ও "গল্প মঞ্জুরী” । তাঁর সম্পাদনায় শিশু-পত্রিকা “আইুর' প্রকাশিত হয়। “বাংলা ভাষার আঞ্চলিক অভিধান" সম্পাদনা তাঁর অসামান্য কীর্তি । মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. ফেরেশতা কেন ইহুদিদের কাছে এসেছিলেন?
ক. সাহায্য নেওয়ার জন্য
খ. পরীক্ষা নেওয়ার জন্য
গ. শিক্ষা দেওয়ার জন্য
ঘ. মূল্যায়নের জন্য
২. তৃতীয় ব্যক্তি ফেরেশতাকে সবকিছু দিতে রাজি হয়েছিল কেন?
ক. আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকায়
খ. তার ছাগল বেশি হয়েছিল
গ. তার আর ধনসম্পদের দরকার ছিলনা
ঘ. সে অকৃপণ ছিল
উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও:
নন্দীপাড়া গ্রামের নওশাদ পরোপকারী মানুষ। এইতো সেদিন প্রতিবেশী কাশিমের বাড়িতে আগুন লাগলে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাশিমকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে নওশাদ। কিন্তু ঠিক কয়েকদিন পরই কাশিম আদালতে নওশাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে দ্বিধা করে না।
৩. উদ্দীপকের নওশাদ এবং “সততার পুরস্কার" গল্পের তৃতীয় ব্যক্তির মানসিকতা কোন দিক থেকে
বেশি সাদৃশ্যপূ্ণ?
ক. কৃতজ্ঞতাবোধ
খ. পরশ্রীকাতরতা
গ. কৃতম্তাবোধ
ঘ. বৈরীভাব
৪. উদ্দীপকের কাশিম এবং গল্পের প্রথম দুই ব্যক্তির আচরণে প্রকাশ পেয়েছে_
i. জীবপ্রেম
ii. মনুষ্যত্ববোধ
iii. পরোপকারিতা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক.iও ii
খ.iও iii
গ.iiও iii
ঘ.i/iiও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন - উদ্দীপকটি পড়ে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও:
কালাম, আবুল ও হাফিজ একই গ্রামে বাস করে। তাদের অবস্থা তেমন ভালো নয়। কোনো মতে দিন অতিবাহিত করে। এ কারণে হাজি সাহেব তার যাকাতের টাকা দিয়ে আবুলকে একটা রিক্সা, কালামকে একটা ভ্যানগাড়ি আর হাফিজকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিলেন। তিনি বললেন, তোমরা পরিশ্রম করে খাও আর তোমাদের সাধ্যমতো গরিব মানুষের উপকার করো । কিছুদিন পর হাজি সাহেব তাদের পরীক্ষা করার জন্য এক ভিক্ষুককে পাঠালেন তাদের কাছে সাহায্য চাইতে । আবুল আর কালাম কোনো সাহায্যই করলো না । কিন্তু হাফিজ বিনা পয়সায় ভিক্ষুকের জামাটা সেলাই করে দিল।
ক. স্বর্গীয় দূত কতজন ইহুদিকে পরীক্ষা করেছিলেন ?
খ. স্বীয় দূত মানুষের ছস্মবেশ ধারণ করেছিলেন কেন?
গ. কালাম ও আবুলের কাজের মধ্যে “সততার পুরস্কার গল্পের যে দিকটি প্রতিফলিত তা ব্যাখ্যা কর।
ঘ.“হাফিজের কাজের মধ্যেই “সততার পুরস্কার' গল্পের মূল শিক্ষা নিহিত+, কথাটি বিশ্লেষণ কর।
0 Comments