Latest courses

বর্ষা - প্রমথ চৌধুরী

 


লেখক-পরিচিতি - প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট যশোর জেলায় জনুগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামে । তার পিতার নাম দুর্গাদাস চৌধুরী । শিক্ষাজীবনে তিনি ছিলেন কৃতী ছাত্র। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিথ্ি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক । বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী ছিলেন চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক। সেই সঙ্গে পরিশীলিত বাগবৈদগ্ধ্যময় রম্যরচনায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার বহু রচনা প্রকাশিত হয়েছে 'বীরবল' ছদ্মনামে । বাত সাহিত্যে চলিত ভাষারীতির প্রথম মুখপত্র “সবুজপত্র' পত্রিকাটি ছিল তারই সম্পাদিত। রবীন্দ্রনাথসহ সমকালীন বিখ্যাত মননশীল লেখকদের অনেকেই ছিলেন এই পত্রিকার লেখক। প্রমথ চৌধুরীর গদ্যশৈলীর নিদর্শন রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ । গল্পকার ও সনেটকার হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে তার বিশিষ্ট অবস্থান রয়েছে। প্রমথ চৌধুরী ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের দোসরা সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।

এমন দিনে কী লিখতে মন যায়?

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি যে, যে দিকে যতদৃর দৃষ্টি যায় সমগ্র আকাশ বর্ষায় ভরে গিয়েছে। মাথার উপর থেকে অবিরাম অবিরল অবিচ্ছিন বৃষ্টির ধারা পড়ছে। সে ধারা এত সূক্ষ্ম নয় যে চোখ এড়িয়ে যায়, অথচ এত স্থুল নয় যে তা চোখ জুড়ে থাকে । আর কানে আসছে তার একটানা আওয়াজ; সে আওয়াজ কখনো মনে হয় নদীর কুলুধ্বনি, কখনো মনে হয় তা পাতার মর্মর । আসলে তা একসঙ্গে ও দুই-ই; কেননা আজকের দিনে জলের স্বর ও বাতাসের স্বর দুই মিলে-মিশে এক সুর হয়ে দীড়িয়েছে।

এমন দিনে মানুষ যে অন্যমনস্ক হয় তার কারণ তার সকল মন তার চোখ আর কানে এসে ভর করে । আমাদের এই চোখ-পোড়ানো আলোর দেশে বর্ধার আকাশ আমাদের চোখে কী যে অপূর্ব স্নিগ্ধ প্রলেপ মাখিয়ে দেয় তা বাঙালি মাত্রেই জানে । আজকের আকাশ দেখে মনে হয়, ছায়ার রঙের কোনো পাখির পালক দিয়ে বর্ধা তাকে আগাগোড়া মুড়িয়ে দিয়েছে, তাই তার স্পর্শ আমাদের চোখের কাছে এত নরম, এত মোলায়েম । 

তার পর চেয়ে দেখি গাছপালা মাঠঘাট সবারই ভিতর যেন একটা নতুন প্রাণের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। সে প্রাণের আনন্দে নারকেল গাছগুলো সব দীড়িয়ে দাড়িয়ে দুলছে, আর তাদের মাথার ঝাকড়া চুল কখনো-বা এলিয়ে পড়ছে, কখনো-বা জড়িয়ে যাচ্ছে। আর পাতার চাপে যেসব গাছের ডাল দেখা যায় না, সেসব গাছের পাতার দল এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে, পরস্পর কোলাকুলি করছে; কখনো-বা বাতাসের স্পর্শে বেঁকে-ঢুরে এমন আকার ধারণ করছে যে, দেখলে মনে হয় বৃক্ষলতা সব পত্রপুটে ফটিকজল পান করছে। আর এই খামখেয়ালি বাতাস নিজের খুশিমতো একবার পাচ মিনিটের জন্য লতা-পাতাকে নাচিয়ে দিয়ে বৃষ্টির ধারাকে ছড়িয়ে দিয়ে আবার থেমে যাচ্ছে। তারপর আবার সে ফিরে এসে যা ক্ষণকালের জন্য স্থির ছিল তাকে আবার ছুঁয়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, সে যেন জানে যে তার স্পর্শে যা-কিছু জীবন্ত অথচ শান্ত সে সবই প্রথমে কেঁপে উঠবে, তার পর ব্যতিব্যস্ত হবে, তারপর মাথা নাড়বে, তারপর হাত-পা ছুড়বে; আর জলের গায়ে ফুটবে পুলক। বৃষ্টির সঙ্গে বৃক্ষপল্লবের সঙ্গে সমীরণের এই লুকোচুরি খেলা আমি চোখ ভরে দেখছি আর কান পেতে পেতে শুনছি। মনের ভিতর আমার এখন আর কোনো ভাবনাচিস্তা নেই, আছে শুধু এমন-একটা অনুভূতি যার কোনো স্পষ্ট রূপ নেই, কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই। 

মনের এমন বিক্ষিপ্ত অবস্থায় কী লেখা যায়? যদি যায় তো সে কবিতা, প্রবন্ধ নয়।


আনন্দে-বিষাদে মেশানো এ অনামিক অনুভূতির জমির ওপর অনেক ছোটোখাটো ভাব মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠছে, আবার মুহূর্তেই তা মিলিয়ে যাচ্ছে । এই বর্ষার দিনে কত গানের সুর আমার কানের কাছে গুনগুন করছে, কত কবিতার শ্লোক, কখনো পুরোপুরি কখনো আধখানা হয়ে আমার মনের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে । আজকে আমি ইংরেজি ভুলে গিয়েছি। যেসব কবিতা যেসব গান আজ আমার মনে পড়ছে সেসবই হয় সংস্কৃত, নয় বাংলা, নয় হিন্দি। 


মেঘৈর্মেদুরম্বরং বনভূবশ্যামান্তমালদ্রমৈঃ


গীতগোবিন্দের এই প্রথম চরণ যে বাঙালি একবার শুনেছে চিরজীবন সে আর তা ভুলতে পারবে না। আকাশে ঘনঘটা হলেই তার কানে ও-চরণ আপনা হতেই বাজতে থাকবে । সেইসঙ্গে মনে পড়ে যাবে মনের কত পুরনো কথা, কত লুকানো ব্যথা । আমি ভাবছি মানুষ ভাষায় তার মনের কথা কত অল্প ব্যক্ত করে, আর কত বেশি অব্যক্ত রয়ে যায়। ভাষায় মনোভাব ব্যক্ত করবার জন্যই যারা এ পৃথিবীতে জনাগ্রহণ করেছেন তারাও, অর্থাৎ কবির দলও, একটি পুরনো গানের প্রথম ছত্রটি ঘুরে-ফিরে ক্রমান্বয়ে আমার কানে আসছে _ “এমন দিনে তারে বলা যায়" । এমন দিনে যা বলা যায় তা হয়ত রবীন্দ্রনাথও আজ পর্যন্ত বলেন নি, শেক্স্পিয়রও বলেন নি । বলেন যে নি, সে ভালোই করেছেন । কৰি যা ব্যক্ত করেন তার ভিতর যদি এই অব্যক্তের ইঙ্গিত না থাকে তা হলে তার কবিতার ভিতর কোনো mystery থাকে না, আর যে কথার ভিতর  mystery নেই, তা কবিতা নয় _ পদ্য হতে পারে । 


সে যাই হোক, আজ আমার কানে শুধু রবীন্দ্রনাথের গানের সুর লেগে নেই, সেইসঙ্গে তিনি বর্ধার যে অসংখ্য ছবি এঁকেছেন সেইসব চিত্র বায়োস্কোপের ছবির মতো আমার চোখের সুমুখ দিয়ে একটির পর আর-একটি চলে যাচ্ছে। ভালো কথা _ এটা কখনো ভেবে দেখেছেন যে, বাংলার বর্ষা রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছেন, ও-খতুর দুই তীর ভাষায় সমান সাকার হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে সেকালের একটা কবিতা আছে যা একাই একশো-

রজনী শাঙন ঘন              ঘন দেয়া গরজন

রিমিঝিমি শবদে বরিষে।

পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে               বিগলিত চীর অঙ্গে

নিন্দ যাই মনের হরিষে ॥


সংগীত হিসেবে এ কবিতা গীতগোবিন্দের তুল্য । আর কাব্য হিসেবে তার অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ । আজ আমার মনের ভিতর দিয়ে যেসব কথা আনাগোনা করছে সেসব এতই বিচ্ছিন্ন এতই এলোমেলো যে, সেসব যদি ভাষায় ধরে তার পর লেখায় পুরে দেওয়া যায় তা হলে আমার প্রবন্ধ এতই বিশৃঙ্খল হবে যে, পাঠক তার মধ্যে ভাবের গোলকরধাধায় পড়ে যাবেন । আর যদি এমন পাঠকও থাকেন যিনি বাংলাদেশের ছেলেভুলানো ছড়া-পাচালির অনুরূপ অস্বন্ধ গদ্যরচনা মনের সুখে পড়তে পারেন তা হলেও আমি আজ মন খুলে লিখতে প্রস্তুত নই । অনেক কথা যা আজ মনে পড়ছে তার যা-কিছু মূল্য আছে তা আমার কাছেই আছে, অপর কারো কাছে নেই। বহুকাল-মৃত বহুকাল-বিস্মৃত কোনো শুকনো ফুলের পাপড়ি যদি হঠাৎ আবিষ্কার করা যায় তা হলে যে সেটিকে এককালে সজীব অবস্থায় সাদরে সঞ্চিত করে রেখেছিল, একমাত্র তারই কাছে সে শুষক্কপুষ্পের মূল্য আছে, অপরের কাছে তা বর্ণগন্ধহীন আবর্জনা মাত্র । মানুষের স্মৃতির ভিতরও এমন অনেক শুকনো ফুল সঞ্চিত থাকে যা অপরের কাছে বার করা যায় না। কিন্তু এমন দিনে তা আবিষ্কার করা যায়।


আবার ঘোর করে এল, বাতি না জ্বালিয়ে লেখা চলে না; আর কালির অপব্যয় করা যত সহজ বাতির অপব্যয় করা তত সহজ নয়। অতএব এইখানেই এ লেখা শেষ করি। 


শব্দার্থ ও টীকা

মর্মর _. শুকনো পাতার খসখস ধ্বনি।

হিল্লোল _. ঢেউ।

এলিয়ে _. শিথিল হয়ে।

পত্রপুট _. পাতা দিয়ে তৈরি ঠোঙা।

ফটিকজল _. স্বচ্ছ পানি।

অনামিক অনুভূতি - নাম দেয়া যায় না এমন অনুভূতি

শ্লোক _. ছন্দোবদ্ধ বাক্য।

“মেঘৈ... মৈ' _. মেঘেতে মেদুর আকাশ, তাল তমালে শ্যামা বনভূমি ৷ জয়দেবের “গীতগোবিন্দ' কাব্যের বর্ষা বর্ণনা। জয়দেবের বর্ষার এই সহজ-সরল রূপ বাঙালির চিরচেনা ।

গীতগোবিন্দ _. কৰি জয়দেবের বিখ্যাত কাব্য্ন্থ।

ঘনঘটা _. মেঘর আড়ম্বর।

ছত্র _. পঙ্ক্তি। লাইন।

Mystery_. রহস্য।

বায়োস্কোপ _. চলচ্চিত্র । ছায়াছবি ।

কান্তমূর্তি _ সুন্দর বা কমনীয় মূর্তি।

সাকার _ আকার বিশিষ্ট ।

ঘন _. মেঘ।

দেয়া _. আকাশ । মেঘ।

বরিষে _. বর্ষিত হচ্ছে।

রঙে _. আনন্দে । আমোদে।

বিগলিত চীর অঙ্গে _ অঙ্গের শিথিল বা অবিন্যস্ত পোশাকে ।

নিন্দ _. নিদ্রা।

হরিষে _. আনন্দে।

গোলকর্ধাধা _. প্রহেলিকা।

পাচালি _. গীতাভিনয়।


পাঠ-পরিচিতি - প্রমথ চৌধুরীর “বর্ষা” প্রবন্ধটি তীর 'প্রবন্ধ সংগ্রহ' (১৯৫২) থেকে সংকলিত এবং ঈষৎ সংক্ষেপিত | নদীমাতৃক এই দেশে বর্ষা খতু অত্যন্ত পরিচিত। অবিরাম বৃষ্টিতে বৃক্ষরাজির অবস্থা, মানব মনের আনন্দ-বিষাদ মাখানো অনুভূতি, বর্ধার গান ও কবিতা, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের বর্ষার চিত্র প্রাবন্ধিকের মন জুড়ে বয়ে চলেছে। এমন দিন প্রতিটি বাঙালি ভাবুকজনের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর অনুভূতি অন্যের কাছে প্রকাশ করা কঠিন । মনায় এই প্রবন্ধটিতে প্রাবন্ধিকের ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। বর্ষা মানবহৃদয়কে যে ভাবাবেগে আপ্লুত করে, একই সঙ্গে করে তোলে সজীব ও স্মৃতিকাতর, নৈঃসঙ্যানুভূতিতে জর্জর ও সৃষ্টিমুখর- তারই মর্মকথা ব্যক্ত হয়েছে এ রচনায় । বর্ষা প্রকৃতিতে যে সজীবতা ও আনন্দানুভূতির সঞ্চার করে তা মানবের প্রাণকেও আন্দোলিত করে গভীরভাবে । এই গভীর হৃদয়ানুভূতি “বর্ষা” প্রবন্ধে অভিব্যক্ত হয়েছে; যার মধ্য দিয়ে এ রচনার ভাষা হয়ে উঠেছে নান্দিনিক অনুভব-সঞ্জাত বক্তব্য প্রকাশের বিশেষ উপযোগী ।

সৃজনশীল প্রশ্ন -  “এইখানে ছিল প্রমন্তা নদী । বর্ষায় এই নদীর জলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে এক অদ্ভুত সুরের জন্ম দিত। আজ এখানে খরা । কতকাল বৃষ্টির শব্দ শুনি না। জলের ফোঁটা পাতার উপর পড়ায় পাতার যে শিহরণ তা দেখে মন ভরে যেত। ঝড়ো বৃষ্টির দাপটে গাছগুলো যেন দাঁড়িয়ে থাকা ভুলে গিয়ে দৌড়ে বেড়াতে চাইত" এভাবেই কাশেম মাঝি তার নাতনিকে বর্ষার গল্প শোনাচ্ছেন । কেন এমন হলো তা কাশেম মাঝি জানেন না। শুধু শুনেছেন পৃথিবীর মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ে যা খুশি তাই করছে। আর এই কারণে প্রকৃতি আজ এমন বিরূপ । তাহলে কি পৃথিবী থেকে বর্ষা বিদায় নেবে? মানুষ আর বর্ষার রিমঝিম শব্দে উদাস হবে না! এই সব ভাবতে ভাবতে কাশেম মাঝির দুচোখ জলে ভরে উঠে । 

ক. প্রমথ চৌধুরী বর্ধার আকাশকে কিসের সাথে তুলনা করেছেন?

খ. বর্ষার বাতাসকে “খামখেয়ালি বলা হয়েছে কেন?

গ. অনুচ্ছেদের প্রথমাংশে কাশেম মাঝির অনুভূতিতে “বর্ধা” প্রবন্ধের যে দিকটি ফুটে উঠেছে তা ব্যাখ্যা কর।

ঘ.অনুচ্ছেদটি “বর্ষা” প্রবন্ধের সমগ্ধ আবহকে ধারণ করতে পেরেছে কি? তোমার মতের পক্ষে যুক্তি দাও।


Post a Comment

0 Comments